সৃষ্টির জন্য ধর্ম প্রয়োজন হয় না, একজন নারী ও একজন পুরুষই যথেষ্ট। আর এই নারী-পুরুষের সঙ্গমকে বৈধতা দেয়ার জন্য বিবাহ প্রথা চালু রয়েছে। আর এটা হয়েছে বিভিন্ন ধর্মের কারণে। বিয়ে করে স্বামী-স্ত্রীর যৌনতা মেনে নিলেও বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক ইসলাম ধর্মে অনৈতিক এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এমনকি এ ধরনের সম্পর্ক করলে নারীদের পাথর ছুড়ে মারার মত নিকৃষ্ট ও জঘন্য ভিডিও এখনো আমরা দেখতে পাই। যা আরব দেশে প্রচলিত। আমাদের দেশেও এই ধরনের আইন করার পক্ষে মোল্লা ও ধর্মভিত্তিক কিছু সংগঠন। এখানে একজন নারী ও পুরুষের ভালোবাসার কোন মূল্য নেই। ধর্মের নামে নীতি নৈতিকতা শেখানোটাই যেন প্রধান কারণ। একটা ধারণা প্রচলিত আছে, ধর্ম নীতি-আদর্শ শেখায়। অথচ বিষয়টি সম্পূর্ণ বিপরীত। প্রতিটি প্রচলিত ধর্মই মানুষকে শেখায় কিছু বিভাজন। বিশেষ করে ইসলাম ধর্ম অন্য ধর্মালম্বীদের হত্যায় উৎসাহ যোগায়। হিজাবের নামে নারীদের বস্তা বন্দি করে রাখার নির্দেশ দেয়। জিহাদের নামে সন্ত্রাসবাদ কায়েম করে। বিজ্ঞানের উন্নতিকে অস্বীকার করে। ডারউইনের তথ্য মিথ্যা প্রমাণের চেষ্টা করে। জন্মের পর থেকে শুনে আসার ফলে এসব ভেঙ্গে বিশ্বাসী মানুষদের বেরিয়ে আসার সুযোগ নেই। অথচ একজন মানুষ কোন ধর্মে জন্মগ্রহণ করবে তাতে তার কোন হাত থাকে না। সব ধর্মই আসলে জন্ম থেকে প্রাপ্ত, তাহলে জন্মকারীর দোষ কি? তাছাড়া সমাজ বা দেশ চালানোর জন্য ধর্মীয় নীতি-আদর্শের কোনো প্রয়োজনীয়তাই নেই। শত শত বছর ধরে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বা সমাজবিজ্ঞানীরা সমাজ বা রাষ্ট্র পরিচালনার জন্যে হাজারো নীতি-আদর্শ-আইন–কানুনের কথা লিখে গেছেন। এ কথাও বলে গেছেন একটি আদর্শ সমাজ বা আধুনিক রাষ্ট্রের কোন ধর্মবিশ্বাস থাকতে নেই , থাকবেও না। ধর্ম বিশ্বাস বা ঈশ্বর বলে যদি কিছু থাকে, তবে তা বেশি প্রয়োজন গরিব, দুর্বল চিত্তের মানুষ এবং অন্ধবিশ্বাসীদের জন্য। সভ্যতার অগ্রগতিতে কোনো প্রাতষ্ঠানিক ধর্মই সহায়ক ভূমিকা নেয়নি বরং বাধা হয়েই দাঁড়িয়েছে। সমাজ ও রাষ্ট্রের যেরকম প্রাতিষ্ঠানিক কোনো ধর্মের প্রয়োজন নেই, ঠিক তেমনি ধর্মের প্রয়োজন নেই কোনো সংস্কৃতিবান, শিক্ষিত ও যুক্তিবাদী মানুষেরও। এক একটি মানুষ নিজেই একজন আল্লাহ, ঈশ্বর বা ভগবান। কবির ভাষায়- তাই একদিন লাশ হবো / পোকার সাথে গলাগালি করে/ সৃষ্টির আধার মাটি হবো/ অবশেষে আমি আবারও ঈশ্বর হব।/ ধর্ম ব্যবহারের আরেকটা সুবিধা আছে। তারা তথাকথিত ধর্মের নামে অধর্মকে জায়েজ করে। এখানে একটি বিষয় স্পষ্ট যে ধর্ম আর ধর্মের নামে অধর্ম একাকার হয়ে যায়। ধর্মের নামে অধর্ম বা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালনাকারী জঙ্গিগোষ্ঠী সব সময়ই দাবি করে আসছে যে তারা ধর্ম রক্ষা করছে। এতে করে তথাকথিত ধার্মিক ব্যক্তিরা জঙ্গি গোষ্ঠীর পক্ষ নেয়। বাংলাদেশের সুবিধাবাদী তথাকথিত ইসলাম ধর্মের মানুষরা দারুন সুবিধাবাদী । তারা কথায় কথায় বলে নাস্তিক দেশের কিংবা বিধর্মী কোন দেশের পণ্য গ্রহণ করবে না। কিন্তু তারা এসব পন্যের উপরই নির্ভরশীল। যেমন শতকরা ৯০% নাস্তিকের দেশ চীনের পণ্য ছাড়া বাংলাদেশে কেন, সারা বিশ্বই এখন অচল। কথায় কথায় ইসরাইলের পণ্য বর্জনের কথা শোনা গেলেও চীনের পণ্য বর্জনের কথা কিন্তু শোনা যায়নি। কারণ চীনের পণ্য অনেক সহজলভ্য এবং সস্তা। আরজ আলী মাতাব্বর লিখেছেন, ১৩৫৮ সালের ১২ই জ্যৈষ্ঠ। বরিশালের তদানীন্তন ল-ইয়ার ম্যাজিস্ট্রেট ও তবলিগ জামাতের আমির জনাব এফ করিম সাহেব আমাকে তাহার জামাতভুক্ত করার মানসে সদলে হঠাৎ তসরিফ নিলেন আমার বাড়ীতে। তিনি আমাকে তাঁহার জামাতভুক্তির অনুরোধ জানাইলে আমি তাহাকে বলিলাম যে, “ধর্ম জগতে এরুপ কতগুলি নীতি, প্রথা, সংস্কার ইত্যাদি এবং ঘটনার বিবরণ প্রচলিত আছে, যাহা সাধারন মানুষের বোধগম্য নহে এবং এগুলি দর্শন ও বিজ্ঞানের সহিত সামঞ্জ্যপূর্ণ নহে, এমনকি অনেকক্ষেত্রে বিপরীতও বটে। ধর্ম, দর্শন ও বিজ্ঞান এই তিনটি মতবাদের সমন্বয় সাধনের উদ্দেশ্য চিন্তা করিতে যাইয়া এক বিভ্রান্তির আঁধার কূপে নিমিজ্জত হইয়া আছি। আপনি আমার প্রশ্নগুলির সুষ্ঠ সমাধানপূর্বক আমাকে সেই বিভ্রান্তির আঁধার কূপ হইতে উদ্ধার করিতে পারিলে আমি আপনার জামাতভুক্ত হইতে পারি।” আরজ আলী এসব প্রশ্নের উত্তর পাননি, তবে পেয়েছিলেন কমুনিউজম প্রচারের অপরাধে আসামী হিসাবে ফৌজদারী মামলার একখানা ওয়ারেন্ট। ধর্মব্যবসায়ীরা যুগে যুগে এভাবেই নানা প্রশ্ন এড়িয়ে গেছেন। জন্মগত বিশ্বাসকে আঁকড়ে ধরার জন্য আনা হত্যাকাণ্ড চালিয়েছেন এবং চালাচ্ছেন।
লেখক : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক