১০ মে ২০২৫, এখন সময় রাত ১:৩১ মিনিট
শিরোনাম
  1. অন্যান্য
  2. অর্থনীতি
  3. আইন-আদালত
  4. আন্তর্জাতিক
  5. কৃষি
  6. খুলনা
  7. খেলাধূলা
  8. গণমাধ্যম
  9. চট্রগ্রাম
  10. জাতীয়
  11. ঢাকা
  12. তথ্য-প্রযুক্তি
  13. ধর্মতত্ত্ব
  14. প্রকৃতি-পরিবেশ
  15. প্রবাস জীবন

এলডিসি থেকে উত্তরণ : চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা

প্রতিবেদক
এ কে নাহিদ
মে ৫, ২০২৫ ৬:০৮ অপরাহ্ণ

স্বাধীনতা-উত্তর ১৯৭১ সাল থেকে বাংলাদেশ জাতিসংঘের স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকায় রয়েছে । এলডিসিতে থাকা দেশগুলো মূলত উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে পিছিয়ে থাকা দেশ। স্বল্পোন্নত দেশগুলো যাতে এগিয়ে যেতে পারে এবং নিজেদের উন্নতি করতে পারে, সে জন্য উন্নত দেশগুলো নানা ধরনের সুবিধা দেয়। বাংলাদেশ নানা ধরনের যাচাই-বাছাই পেরিয়ে ২০২৬ সালের ২৪ নভেম্বর এলডিসি থেকে উত্তরণের জন্য সময় নির্ধারণ করেছে। উল্লেখ্য, এলডিসি থেকে উত্তরণ হলে একটি দেশের মানমর্যাদা আরও বৃদ্ধি পায়। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে নিজেদের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল এবং অর্থনৈতিক সক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ হয়। এতে বিদেশি বিনিয়োগকারী আস্থা রাখতে পারেন। একটি দেশের সমৃদ্ধি বিবেচনা করা হয় দেশটি কোন শ্রেণিতে আছে, এর ওপর। অন্যদিকে এলডিসি তালিকায় থাকলে ওই দেশকে নানা ধরনের সুবিধা দিয়ে এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দেয় উন্নত দেশগুলো। এটি অনেকটা পরনির্ভরশীলতায় থাকার মতো বিষয়। এরই আলোকে এলডিসি থেকে উত্তরণের চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা প্রেক্ষিত বাস্তবত নিয়ে এবারের টাইমওয়াচ প্রচ্ছদ প্রতিবেদন; লিখেছেন এ কে নাহিদ
বাংলাদেশ এলডিসির যাত্রা শুরুর প্রেক্ষাপট
বিশ্বে ১৯৭১ সাল থেকে স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) যাত্রা শুরু হয়। বাংলাদেশ ১৯৭৩ সাল থেকে এলডিসি তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ার জন্য দর-কষাকষি শুরু করে। প্রথম পরিকল্পনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান অধ্যাপক নুরুল ইসলামের একান্ত প্রচেষ্টায় ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশ প্রথম এলডিসি তালিকায় যুক্ত হয় । এলডিসিভুক্ত দেশ হওয়ার কারণে শুল্কমুক্ত বাণিজ্য-সুবিধাসহ নানা সুবিধা পেয়েছে বাংলাদেশ। দেশের বর্তমান যে অগ্রগতি, তার মূল কারণ এই এলডিসিভুক্তি। জনসংখ্যা, অর্থনৈতিক সক্ষমতা, ছোট দ্বীপপুঞ্জ, ভূবেষ্টিত দেশ; এসব বৈশিষ্ট্যের ওপর ভিত্তি করে এলডিসিতে তালিকাভুক্ত করে জাতিসংঘ। কিন্তু বাংলাদেশ এসব বৈশিষ্ট্যের মধ্যে ছিল না। বাংলাদেশকে জনসংখ্যার আধিক্যের বিচারে অর্থনৈতিক সক্ষমতা কম; এমন বিশেষ ব্যবস্থায় নিয়েছিল জাতিসংঘ।
এলডিসি কী ও কারা
অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে উন্নয়নশীল ও উন্নত-এই দুই শ্রেণিতে সব দেশকে ভাগ করে থাকে জাতিসংঘ। তবে উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে যে দেশগুলো তুলনামূলক দুর্বল, তাদের নিয়ে ১৯৭১ সালে স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা হয়। স্বল্পোন্নত দেশ হলেও এসব দেশও একধরনের উন্নয়নশীল দেশ।বর্তমানে বিশ্বে ৪৪টি স্বল্পোন্নত দেশ রয়েছে। দেশগুলো হলো- বাংলাদেশ, আফগানিস্তান, অ্যাঙ্গোলা, বেনিন, বুরকিনা ফাসো, বুরুন্ডি, কম্বোডিয়া, সেন্ট্রাল আফ্রিকা, চাদ, কমরোস, কঙ্গো, জিবুতি, ইরিত্রিয়া, ইথিওপিয়া, গাম্বিয়া, গিনি, গিনি বিসাউ, হাইতি, কিরিবাতি, লাওস, লেসেতে, লাইবেরিয়া, মাদাগাস্কার, মালাউই, মালি, মৌরিতানিয়া, মোজাম্বিক, মিয়ানমার, নেপাল, নাইজার, রুয়ান্ডা, সেনেগাল, সিয়েরা লিওন, সলোমন দ্বীপপুঞ্জ, সোমালিয়া, দক্ষিণ সুদান, সুদান, তিমুর, টোগো, টুভালু, উগান্ডা, তানজানিয়া, ইয়েমেন ও জাম্বিয়া।এলডিসি থেকে উত্তরণের নিয়মএলডিসি থেকে কোনো দেশ বের হবে, সে বিষয়ে সুপারিশ করে জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসি (সিডিপি)। এ জন্য প্রতি তিন বছর পরপর এলডিসিগুলোর ত্রিবার্ষিক মূল্যায়ন করা হয়। মাথাপিছু আয়, মানবসম্পদ, জলবায়ু ও অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা এই তিন সূচক দিয়ে একটি দেশ উন্নয়নশীল দেশ হতে পারবে কি না, সেই যোগ্যতা নির্ধারণ করা হয়। যেকোনো দুটি সূচকে যোগ্যতা অর্জন করতে হয় কিংবা মাথাপিছু আয় নির্দিষ্ট সীমার দ্বিগুণ করতে হয়। এই মানদণ্ড সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তিত হয়।
সিডিপি পরপর দুটি ত্রিবার্ষিক মূল্যায়নে এসব মান অর্জন করলেই এলডিসি থেকে বের হওয়ার চূড়ান্ত সুপারিশ করে সিডিপি। সিডিপির সুপারিশ প্রথমে জাতিসংঘের ইকোসকে যায়। প্রস্তুতির জন্য তিন বছর সময় দেওয়া হয়। তিন বছর পর জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে অনুমোদনের জন্য ওঠে। এরপর চূড়ান্তভাবে এলডিসি থেকে উত্তরণের হয়ে যায় ওই দেশ। এ প্রক্রিয়ায় এই দেশটির ইচ্ছা-অনিচ্ছার খুব একটা প্রভাব থাকে না।
বাংলাদেশ ২০১৮ ও ২০২১ সালের ত্রিবার্ষিক মানদণ্ডের তিনটিতেই উত্তীর্ণ হয়। ২০২১ সালেই বাংলাদেশ চূড়ান্ত সুপারিশ পায় যে ২০২৪ সালে এলডিসি থেকে উত্তরণ হতে পারে বাংলাদেশ। ২০২৪ সালে এলডিসি থেকে বের হওয়ার কথা থাকলেও করোনার কারণে প্রস্তুতির জন্য আরও দুই বছর পিছিয়ে দেওয়া হয়। বাংলাদেশ যদি এলডিসি থেকে উত্তীর্ণ হয়, তাহলে বাংলাদেশই হবে প্রথম দেশ, যারা তিনটি সূচকেই উত্তীর্ণ হয়ে বের হবে।
৫০ বছরে মাত্র আটটি দেশ এলডিসি থেকে বের হয়েছে
ষাটের দশকে স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) ধারণাটি আসে। তবে ১৯৭১ সালে প্রথম স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা করা হয়। এ পর্যন্ত গত পাঁচ দশকে সব মিলিয়ে মাত্র আটটি দেশ এলডিসি থেকে বের হয়েছে। দেশগুলো হলো- ভুটান, বতসোয়ানা, কেপ ভার্দে, ইকুইটোরিয়াল গিনি, মালদ্বীপ, সামোয়া, ভানুয়াতু, সাও টোমো অ্যান্ড প্রিন্সেপ।
১৯৭১ সালে এলডিসির তালিকা হওয়ার ২৩ বছর পর ১৯৯৪ সালের ডিসেম্বর মাসে প্রথম দেশ হিসেবে বতসোয়ানা উত্তরণ করে। আর সর্বশেষ ২০২৪ সালের ডিসেম্বর মাসে সাও টোমো অ্যান্ড প্রিন্সেপ অষ্টম দেশ হিসেবে এলডিসি থেকে বের হয়। ২০২৩ সালের ডিসেম্বর মাসে বের হয় ভুটান।
আগামী পাঁচ বছরে এলডিসি তালিকা থেকে বের হতে অপেক্ষায় ছয়টি দেশ। এর মধ্যে বাংলাদেশ আছে। বাংলাদেশ ছাড়াও ২০২৬ সালে এলডিসি থেকে উত্তরণের তালিকায় আরও দুটি দেশ লাওস ও নেপাল আছে। কম্বোডিয়া ও সেনেগাল ২০২৯ সালে এলডিসি থেকে বের হওয়ার কথা আছে। নিজেদের অক্ষমতার কথা জানিয়ে সলোমন দ্বীপপুঞ্জ এলডিসি থেকে বের হওয়ার সময় বাড়ানোর আবেদন করেছিল। এখন ২০২৭ সালে ওই দেশ এলডিসি থেকে বের হবে।


এলডিসি, উন্নয়নশীল দেশ ও মধ্যম আয়ের দেশ কী
এলডিসি, উন্নয়নশীল দেশ ও মধ্যম আয়ের দেশ-এসব দেশের সংজ্ঞা নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি আছে। কোন দেশ কোন শ্রেণিতে, তা নিয়ে অনেকের পরিষ্কার ধারণা কম। এবার বিষয়টি পরিষ্কার করা যাক। অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রোপট বিবেচনা করে উন্নয়নশীল ও উন্নত- এই দুই শ্রেণিতে সব দেশকে ভাগ করে থাকে জাতিসংঘ। আবার উন্নয়নশীলগুলোর মধ্যে যেসব দেশ দুর্বল, সেসব দেশকে এলডিসি তালিকাভুক্ত করা হয়। ওই দেশের আর্থসামাজিক পরিস্থিতির উন্নতি হলে সেসব দেশকে এলডিসি থেকে বের করে দেওয়া হয়। মনে রাখতে হবে, এলডিসি দেশগুলোও একধরনের উন্নয়নশীল দেশ। এসব দেশকে সাহায্য-সহযোগিতা দিয়ে তাদের আর্থসামাজিক উন্নয়নে সহায়তা করা হয়। বাংলাদেশ এখনো এলডিসি। অন্যদিকে বিশ্বব্যাংক শুধু মাথাপিছু আয়ের ওপর ভিত্তি করে বিভিন্ন দেশকে শ্রেণিভুক্ত করে। শ্রেণিগুলো হলো- নিম্ন আয়ের দেশ; মধ্যম আয়ের দেশ এবং উচ্চ আয়ের দেশ। বিশ্বব্যাংকের হিসাব অনুসারে, বর্তমানে কোনো দেশের মাথাপিছু আয় ১ হাজার ১৪৫ মার্কিন ডলারের কম হলে সেটি নিম্ন আয়ের দেশ হিসেবে চিহ্নিত হয়। এ ছাড়া মাথাপিছু আয় ১ হাজার ১৪৬ থেকে ৪ হাজার ৫১৫ ডলার হলে নিম্নমধ্যম আয়ের দেশ এবং ৪ হাজার ৫১৬ থেকে ১৪ হাজার ৫ ডলার হলে উচ্চমধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে গণ্য হয়। আর ১৫ হাজার ৫ ডলারের বেশি মাথাপিছু আয় হলে উচ্চ আয়ের দেশ চিহ্নিত হয়। বাংলাদেশ এখন নিম্নমধ্যম আয়ের দেশ। জাতিসংঘ ও বিশ্বব্যাংকের হিসাব অনুসারে, বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ ও উন্নয়নশীল দেশ। আবার নিম্নমধ্যম আয়ের দেশও বাংলাদেশ।
রপ্তানি কমার আশঙ্কা
বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানি ৮০ শতাংশের বেশি তৈরি পোশাক খাত থেকে আসে। আর তৈরি পোশাক রপ্তানির ৫০ শতাংশের গন্তব্য ইইউ। বর্তমানে এই বাজারে অগ্রাধিকারমূলক বাজার-সুবিধা বা জিএসপির অধীন শুল্কমুক্ত সুবিধা পায় বাংলাদেশ। এলডিসি থেকে উত্তরণের পর আরও তিন বছর সুবিধাটি পাবে বাংলাদেশ। তারপর জিএসপি প্লাস না পেলে গড়ে ১২ শতাংশ শুল্ক দিয়ে ইইউর বাজারে তৈরি পোশাক রপ্তানি করতে হবে। নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে এলডিসি থেকে উত্তরণে সিদ্ধান্ত নেওয়ার মধ্য দিয়ে আমরা আত্মহত্যার প্রস্তুতি নিচ্ছি। আমাদের সমসাময়িক সময়ে যেসব দেশ উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে উত্তরণের প্রস্তুতি নিচ্ছে, তাদের তৈরি পোশাক রপ্তানি নেই। ফলে তাদের হারানোর কিছু নেই। এলডিসি থেকে উত্তরণের প্রস্তুতি হিসেবে প্রণোদনা কমিয়ে দেওয়ায় দেশের বস্ত্র খাত নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে দাবি করেন মোহাম্মদ হাতেম। তৈরি পোশাকের পর বাংলাদেশের শীর্ষ রপ্তানি খাতের একটি চামড়া ও চামড়া পণ্য। দীর্ঘদিন ধরে এই খাতের রপ্তানি ১০০ কোটি ডলারের আশপাশেই ঘুরছে। এলডিসি থেকে উত্তরণের কারণে চামড়া ও চামড়া পণ্যে নেতিবাচক পড়বে এমন মন্তব্য করেছেন চামড়াপণ্য ও জুতা উৎপাদন ও রপ্তানিকারক সমিতির (এলএফএমইএবি) সহসভাপতি মো. নাসির খান। তিনি বলেন, আমরা কঠিন বিপদে পড়ব। কারণ, আমরা প্রস্তুত নই। শুল্কমুক্ত সুবিধা পেয়েও চামড়া খাত দাঁড়াতে পারেনি। শুল্কমুক্ত সুবিধা না থাকলে ভয়াবহ অবস্থা হবে।
হস্তশিল্প রপ্তানির পরিমাণ কম হলেও অনেক ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা এই খাতের সঙ্গে যুক্ত। বর্তমানে পাটপণ্যে ১০ শতাংশ ও হস্তশিল্পে ৮ শতাংশ প্রণোদনা দেয় সরকার। এলডিসি থেকে উত্তরণের কারণে প্রণোদনা না থাকলে ক্রয়াদেশ হারানোর শঙ্কা করছেন হস্তশিল্প খাতের উদ্যোক্তারা। বহুমুখী পাটপণ্য রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান ক্রিয়েশন প্রাইভেট লিমিটেডের ব্যবস্থাাপনা পরিচালক মো. রাশেদুল করিম বলেন, শুল্কমুক্ত সুবিধা ও প্রণোদনা না থাকলে তীব্র প্রতিযোগিতার মুখে পড়তে হবে। তার জন্য দতা ও পণ্যের এবং প্রযুক্তির উন্নয়নেও বিনিয়োগ প্রয়োজন হবে। এসব প্রস্তুতি জন্য আরও কয়েক বছর উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ পেছানো দরকার।
এলডিসি থেকে উত্তরণ : ক্ষুব্ধ রপ্তানিকারকরা
বর্তমান অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের মধ্যে এলডিসি থেকে উত্তরণের সিদ্ধান্ত নেওয়ায় রপ্তানিকারকদের একটি অংশক্ষুব্ধ। তারা বলছেন, এলডিসি থেকে উত্তরণের পর পণ্য রপ্তানিতে বাজার সুবিধা মিলবে না। দেওয়া যাবে না প্রণোদনা। এতে বাংলাদেশি পণ্যের প্রতিযোগিতা ক্ষসমতা কমবে। চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সুনির্দিষ্ট উদ্যোগ ছাড়া এলডিসি থেকে উত্তরণের সিদ্ধান্ত আত্মঘাতী। কেন হঠাৎ এমন সিদ্ধান্ত নিল, সেটি তাদের বোধগম্য নয়। এলডিসি থেকে বের হলে চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়বে বাংলাদেশের রপ্তানি খাত। কারণ, এলডিসি হিসেবে বাংলাদেশ বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) আওতায় শুল্কমুক্ত বাজার-সুবিধা পায়। এর ফলে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ), যুক্তরাজ্য, ভারত, চীন, অস্ট্রেলিয়াসহ বিভিন্ন দেশে শুল্কমুক্ত সুবিধায় পণ্য রপ্তানি করা যায়। বিদ্যমান নিয়ম অনুযায়ী, এলডিসি থেকে উত্তরণের পর এই বাজার-সুবিধা বন্ধ হয়ে যাবে। তবে ইইউ জিএসপির আওতায় এই শুল্কমুক্ত সুবিধা থাকবে ২০২৯ সাল পর্যন্ত। যুক্তরাজ্যও একইভাবে সুবিধা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এলডিসি হিসেবে যেকোনো দেশ তার দেশে উৎপাদিত পণ্য বা সেবার ওপর নগদ সহায়তা ও ভর্তুকি দিতে পারে। বাংলাদেশও পণ্য রপ্তানিতে নগদ সহায়তা দেয়। করসুবিধা, ভর্তুকিসহ নানা ধরনের সুবিধা পান দেশীয় উদ্যোক্তারা। তবে এলডিসি থেকে উত্তরণের পর নগদ সহায়তা না দেওয়ার বাধ্যবাধকতা তৈরি হবে। তারই প্রস্তুতি হিসেবে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী সরকারের আমলে দুই দফায় বিভিন্ন খাতের পণ্য রপ্তানিতে প্রণোদনা কমানো হয়।
এলডিসি উত্তরণের চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা
এলডিসি থেকে বের হলে সবচেয়ে সমস্যায় পড়তে হবে বাংলাদেশের রপ্তানি খাতকে। কারণ, এলডিসি হিসেবে বাংলাদেশ বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) আওতায় শুল্কমুক্ত বাণিজ্য-সুবিধা পায়। ইউরোপীয় ইউনিয়নের তো আঞ্চলিক বা দ্বিপক্ষীয় ভিত্তিতেও (যেমন- ভারত, চীন) এ ধরনের শুল্কসুবিধা পেয়ে থাকে। বিদ্যমান নিয়ম অনুযায়ী, ২০২৬ সালে এসব সুবিধা বন্ধ হয়ে যাবে। যদিও ইউরোপীয় ইউনিয়নে জিএসপির আওতায় এই শুল্কমুক্ত সুবিধা থাকবে ২০২৯ সাল পর্যন্ত।
বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে ওষুধশিল্প। এলডিসি থেকে বের হলে ওষুধশিল্পের ওপর মেধাস্বত্ব বিধিবিধান আরও কড়াকড়ি হবে। এলডিসি হিসেবে বাংলাদেশের ওষুধ প্রস্তুতকারক কোম্পানিগুলোকে আবিষ্কারক প্রতিষ্ঠানকে মেধাস্বত্বের জন্য অর্থ দিতে দিতে হয় না। এ কারণে এলডিসির গরিব নাগরিকেরা স্বল্প মূল্যে ওষুধ পায়। ২০৩৩ সালের আগে কোনো দেশ স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বের হয়ে গেলে ওষুধশিল্পের এই সুবিধা থাকবে না।
এলডিসি হিসেবে যেকোনো দেশ তার দেশে উৎপাদিত পণ্য বা সেবার ওপর নগদ সহায়তা ভর্তুকি দিতে পারে। বাংলাদেশ এখন যে রপ্তানি আয় বা রেমিট্যান্স আনায় নগদ সহায়তা দেয়, তা নিয়ে আপত্তি উঠতে পারে। এলডিসি থেকে উত্তরণ হওয়া দেশগুলো আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থাগুলোর কাছ থেকে সহজ শর্তের ঋণ পাওয়ার সুযোগ সীমিত হতে পারে।
এলডিসি থেকে বের হলে জাতিসংঘে চাঁদার পরিমাণ বেড়ে যাবে। আন্তর্জাতিক সংস্থা ও উন্নত দেশগুলো স্বল্পোন্নত দেশের শিক্ষার্থীদের নানা ধরনের বৃত্তি দেয়। এলডিসি থেকে উত্তরণ হলে এ ধরনের বৃত্তির সংখ্যা কমে যাবে। এবার দেখা যাক, এলডিসি থেকে উত্তরণ হলে কী ধরনের লাভ হতে পারে। এলডিসি থেকে বের হলে প্রথমে যে লাভটি হবে, তা হলো বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে। গরিব বা স্বল্পোন্নত দেশের তকমা থাকবে না। অর্থনৈতিক সক্ষমতার কারণে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক ঋণদাতা সংস্থাগুলোর কাছ থেকে বেশি সুদে অনেক বেশি ঋণ নেওয়ার সক্ষমতা বাড়বে।
এলডিসি উত্তরণের পর বাংলাদেশকে যেসব চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হবে, তার মধ্যে অন্যতম হলো- পণ্য বৈচিত্র্যকরণ। এ ক্ষেত্রে কোন কোন পণ্য ও খাতকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন, তা খুঁজে বের করে অগ্রাধিকারভিত্তিক কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। এলডিসি উত্তরণ-পরবর্তী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য খাতভিত্তিক অ্যাসোসিয়েশনসহ ব্যবসায়ী সম্প্রদায়কে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। মনে রাখতে হবে, ব্যবসার ক্ষেত্রে কোনো দেশ আমাদের বন্ধু নয়, সবাই প্রতিযোগী। এটা মেনে নিয়ে নিজেদের মধ্যে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করতে হবে। চ্যালেঞ্জের তুলনায় সামনে সুযোগ অনেক বড়। একসঙ্গে কাজ করতে পারলে সেই সুযোগ কাজে লাগানো সম্ভব।
প্রস্তুতি নিতে হবে এখনই
এলডিসি থেকে উত্তরণের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কয়েকটি কাজ দ্রুত শুরু করার দরকার বলে মনে করেন বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান র‌্যাপিডের চেয়ারম্যান আবদুর রাজ্জাক। তিনি বলেন, ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) সঙ্গে জিএসপি প্লাস সুবিধাপ্রাপ্তি নিয়ে দর-কষাকষি শুরু করা উচিত। এলডিসি থেকে উত্তরণের পর তারা শুল্কমুক্তসুবিধা দিতে পারে কি না। এ ছাড়া ব্যবসার খরচ কমানোর উদ্যোগ নিতে হবে। নগদ সহায়তা না দিয়েও ভারত যেভাবে পণ্য রপ্তানিতে সুযোগ-সুবিধা দেয়, সেভাবে আমাদের দেশেও দেওয়া সম্ভব। আবার এলডিসি থেকে উত্তরণের পর তিন বছর প্রণোদনা অব্যাহত রাখারও সুযোগ রয়েছে, সেটিও মনে রাখতে হবে। তাই এখন থেকেই আমাদেরকে প্রস্তুতি নিতে হবে।

সর্বশেষ - আইন-আদালত