পাশের বাড়ির এক বয়স্ক মহিলাকে আমরা নানি বলে ডাকতাম। তাও আবার হঠাৎ যদি সামনে পরে যেত। নানির অনুপস্থিতে তাকে বোঝানোর জন্য সবাই বলতো ‘হইর বাড়ির বুড়ি’। হহির বাড়ির বুড়ির একমাত্র মেয়ে তাও পাগল হয়ে গেছে। হইর বাড়ির বুড়ি গাছের নিচে পড়ে থাকা (পেকে পরে থাকতো) লেবুগুলো নিয়ে যেতো। ঘরে ঢুকেই কাঁঠাল ভেঙে সকলকে দিচ্ছে নিজে খাওয়ার জন্য। হইর বাড়ির বুড়ি আমাদের খই ও মুড়ি ভেজে দিতো। ফকির বাড়ির এই নানিবুড়ি আমার দাদিমার বয়সি। আমার দাদিমা ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দের ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে মারা গিয়েছে। নানিবুড়ি আমার দাদিমার বয়সি বলে আমার বাবা ও মা বুড়িকে খালাম্মা বলে সম্বোধন করেন। আমার মরহুম বাবা তখন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। ১৯৮৬/৮৭ খ্রিষ্টাব্দের সময়কালীন বেতন খুবই কম থাকায় তাকে অনেক কষ্ট করে আমাদের সংসার পরিচালনা করতে হয়েছে। অন্যদিকে আমার পিতা তার পৈত্তিক সম্পত্তিতে বিভিন্ন শাক-সবজি ও ধানের আবাদ করতেন। আমাদের জমিতে চাষ হতো- মরিচ, কয়েক ধরনের ডাল, ছোলা বুট, গোল আলু, মিষ্টি আলু, বাদামসহ বিভিন্ন ফসল । এছাড়াও বিভিন্ন জাতের ধান বারোমাসি চাষ হতো। প্রচুর পাট চাষ হতো। আমাদের কিছু গরু ছিল; যার জন্য দুইজন পুরুষ কাজের লোক (সাহায্যকারী) বারোমাস থাকতো। আমি দেখেছি, আমার বাবা কিছু লোকজন নিয়ে বাড়ির ভেতরে আসতো। শুকনো মরিচ মেপে কয়েক মন তারা ভ্যানগাড়ি বোঝাই করে নিয়ে যেত। বাবা আবার বের হতো সাথে আমাদের বারোমাসী কাজের লোকের সিনিয়রজন; সাহায্যকারীর হাতে ব্যাগের বিভিন্ন রকম ডালের নমুনা। বাজারে যাচ্ছেন ব্যবসায়ীদের সাথে দাম ফাইনাল করতে। আমাদের এলাকায় বাজার বসে সপ্তাহের দু’দিন- সোমবার ও বৃহস্পতিবার। এই দু’দিন লোকজন বিভিন্ন জিনিস কেনার জন্য বাড়ি বাড়ি ঘুরে যায়। কিন্তু বাবা স্কুলে থাকার কারণে কথা বলার মানুষ থাকেন না, মা কোনো পুরুষের সাথে কথা বলেন না, দেখা দেন না। মহিলা সাহায্যকারীকে দিয়ে অথবা আমাদের ছোট ছোট ভাই বোনদের দিয়ে বলে দেন, বাবা এলে বাবা কথা বলবেন।
ফকির বাড়ির বুড়ি সামনের ঘরে এসে খুবই উচ্চস্বরে বাবাকে বলছে, আব্বা আল্লাহর রহমতে খুবই সুন্দর একটা বইন হয়েছে আমাদের। আম্মা ও বইন দু’জনই সুস্থ আছে।। বাবা হাসি দিয়ে বলল- আলহামদুলিল্লাহ। আমি বাজার থেকে আসার সময় মিষ্টি নিয়ে আসবো। এবার বাবা চলে যাওয়ার পরে ফকির বাড়ির বুড়ি মাকে কইলো- রহমানের মা তুমি অনেক ভাগ্যবান মহিলা। ৫ নাম্বার মেয়ের জন্ম দিয়েও স্বামীর কালো মুখ দেখতে হলো না। নানি বুড়ি আবার বলল- পাঁচটা মেয়ে তো নয় ছয়টা। ১৯৭০ খিষ্টাব্দের ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে পারুল মারা না গেলে তো ছয়টাই হতো । আজ যদি পারুল ও রহমান বেঁচে থাকতো কত বড় হতো; এই বলেই বুড়ির সেকি কান্না! কান্নার বিশেষ কারণ হলো- তার সন্তানদ্বয়ও ৭০’র বন্যায় মারা গিয়েছে।এই কথাগুলো যখন শুনি তখন আমার মনে হল এই প্রথম আমি কথা মনে রাখতে পারলাম; এর আগে আমাকে বা পরিবারের কারও কথাই আমার মনে নেই। কারণ ১৯৮৩ খ্রিষ্টাব্দের ৩০ ডিসেম্বর আমার জন্ম। তখনও আমিবেশ ছোট। বুড়ি আবার বলে উঠলো- গতবছর একটা ছেলে হয়ে মারা গেছে এখন পাঁচটা মেয়ে, একটামাত্র ছেলে। এবার আমার মা কথা বলে উঠলো, আমার মা আনোয়ারা বেগম সেই নজিবুর রহমানের আনোয়ারা উপন্যাসের নায়িকা আনোয়ারার মতই লাল টুকটুকে দেখতে।। সদ্য একটি কন্যাসন্তান জন্ম দিয়েছেন, শরীর এমনেই নানা উপসর্গের কারণে অশান্ত, মুখে হাসি ধরে রাখলেও মনে মনে হয়তো একটু কষ্ট-ই পেয়েছেন। তার উপর আবার নানিবুড়ি কী শুরু করলো! রাগ চেপে রেখে বললো খালাম্মা অনেক হয়েছে, এইবার থামুন। মেয়ে জন্ম হলে আল্লাহর রহমত হয়, বেহেশত পাওয়া যায়। পরের বছর মায়ের আরেকটা ছেলেশিশু হয়ে সন্তান নেওয়ার প্রক্রিয়া আল্লাহ প্রদত্ত নিয়মে বন্ধ হলো।। মায়ের কোলে ছোট্ট শিশু সন্তান আমার ভাই; এরই মধ্যে আমার বড় বোনের বিয়ে হলো। বিয়ে হলো তার থেকে অনেক বছর বয়সের পার্থক্যের এক মিলিটারির সাথে । আমাদের এলাকায় স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা না থাকার কারণে (ক্লাস এইট পর্যন্ত ছিল) আমার বোন ক্লাস এইট পর্যন্তই পড়াশোনা করেছেন। তার বিয়ে হয়েছে এক নন মেট্রিক মিলিটারির সাথে। বাবা অফিসের কাজে চরফ্যাশন আসতো; কখনো পায়ে হেঁটে, কখনো রিক্সা করে পথে ভেঙে ভেঙে যেতো। তেমন কোনো আত্মীয়-স্বজনও চরফ্যাশন ছিল না বলে কোথাও রেখে পড়ানোর সুযোগ হয়নি। বাবা উচ্চ শিক্ষিত ভোলা সদরে পড়াশুনা করেছেন, এখান থেকে পায়ে হেঁটে কিংবা বিভিন্নভাবে কষ্ট করে উচ্চ শিক্ষিত হয়েছেন। সেই বাবা কেনো তার মেয়ে বিয়ে দিল নন মেট্রিক একজন লোকের কাছে! তাও বয়সের এতো পার্থক্য। আমি আমার বোনের জামাইয়ের সামনে যাই না কারণ আমার বাবাকেও অপছন্দ হওয়া শুরু হয়েছে; এই জামাইকে তো আমি দেখতেই চাই না, যদিও মুখে বলার মত বয়স বা সাহস হয়নি আমার। এরই মধ্যে খবর হলো- চর শশীভূষণ মাদ্রাসায় দাখিল পরীক্ষার অনুমোদন পেয়েছে। আমার মায়ের দূর সম্পর্কের ভাই বসির মিয়া তার দুই মেয়ে এলো আমার দুই বোনের পরীক্ষা দেওয়ানোর কথা বলার জন্য। বড়বোনের জামাই রাজী হলো না। মেঝ বোন পরীক্ষা দিলো, এক বিষয়ে ফেল করলো। ৫/৭ পরই মেঝ বোনের বিয়ে, পরীক্ষার কথা কোনোপক্ষই গুরুত্ত দিলোনা। বোন জামাই মেট্রিক ফেল বাবার সাথে কথা বলে জানতে পারলাম এসবই শেষ নবীর ভক্ত উম্মতরা করেছিলো তাই তারা বেহেশতে যাবে। (যদিও এদের আর্থিক অবস্থান অনেক ভালো।) আমি বাবাকে কিছুতেই ক্ষমা করতে পারলাম না।
১৯৯১ খ্রিষ্টাব্দে আবার জলোচ্ছ্বাস হলো, লোকজন আশ্রয় কেন্দ্রে আশ্রয় নিল। আমার বাবা অনেক মানুষকে সাহায্য করলো। আমার চাচা জাফরউল্লাহ চৌধুরীর গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র ঢাকা’য় চাকরি করতো। আমার চাচা সেখান থেকে এলাকায় রিলিফ নিয়ে এল। বাড়ি ভর্তি লোকজন এসে এসে রিলিফের প্যাকেট নিয়ে যাচ্ছে। স্কুল-মাদ্রাসাসহ বিভিন্ন জায়গায় ক্যাম্প করে রিলিফ দেওয়া শুরু হলো । দৃশ্যগুলো এতো ভালো লাগলো- বেশ উপভোগ করছিলাম। বড় বোন যশোর ক্যান্টনমেন্ট থাকে। বোন জামাই চিঠি পাঠালো- আমার বোন ব্লক বাটিক শিখবে বিজনেস করবে; তো ছোট মেয়েটাকে রাখার জন্য যেন আমাকে নিয়ে আসে। আমি বললাম- বাবা আমি যাবো না, আমার পড়াশুনা আছে। বাবা আমাকে ধমক দিলো, বাবার কথা বুঝতে পারলাম। আমার বোন বিজনেস করলে উন্নত হবে; এই বিচার থেকেও তার মেয়ে জামাই মানে (পুরুষ মানুষ) যেটা বলেছে সেই কথার গুরুত্ব দেওয়ার জন্যই বাবা আমাকে নিয়ে যাচ্ছেন। কয়েকদিনের কথা বলে ৬ মাস পরে বাবা আমাকে নিতে আসলো। বাবার কাছ থেকে জানলাম- ছয় মাসের কথা বাবা জানতো না; ওরা চিঠি লিখে আসতে না করেছিলো। ক্লাস ফোরের বার্ষিক পরীক্ষা না দিয়েই ক্লাস ফাইভে উঠেছি। ইচ্ছে ছিল আমি ফাইভে বৃত্তি পরীক্ষা দিব সবাইকে সাথে নিয়ে এগিয়ে যাবো, আমি বৃত্তি পাবো। তা হলো না। এরকম বিভিন্ন কারণে রাগ থেকে আমি বিদ্রোহী কন্যা হয়ে ওঠা শুরু করি।
আমার মাথার কাপড় ফেলে হাঁটা যাবে না, আমার উচ্চস্বরে কথা বলা যাবে না। আমার হাসা যাবে না বহুৎ কিছু। এবার বাবা-মা আমাকে ধরিয়ে দিল আবার সেই বেহেস্তের চাবি। আমাকে তারা আটকে রাখতে পারবে না। আমি ক্লাস ফাইভ পাস করে হাই স্কুলে ভর্তি হয়ে গেলাম।। তখন আমার সেজো বোন এসএসসি পরীক্ষার্থী, বোনকে বিয়ে দিতে বাবা উঠে পড়ে লেগে গেল আমি বোনের অনুরোধে এক এক করে সকল বিয়ে ভেঙে দিতে লাগলাম। আমাদের গ্রামে বড় বাড়ি হওয়াতে আমাদের প্রচুর ফল ছিল- আম, জাম, কাঁঠাল, পেয়ারা, নারিকেল ইত্যাদি। লোক দিয়ে গাছ থেকে নামাতো। আমি নিজেই গাছে উঠে পারতাম। বাবা বিরক্ত হতো। পাকা ফসল তোলার সময় ২০/৩০ জন লোক নিয়ে ফসল তুলতে হতো, ধান কাটার দিন আরো অনেক বেশি লাগতো। এ সময় নিজেদের লোক থাকলে ভালো হয়। বাবা চাকরির জন্য প্রায়ই সময় পেতো না। আমি দাঁড়িয়ে পাহারা দেওয়ার কাজ করতে চাইতাম।। কিন্তু আমি নারী! আমি যেতে পারবো না। আমি জোর করে চলে যেতাম। যখন প্রাইমারি স্কুলে পড়তাম তখন থেকে সব ছেলে-মেয়েরা যে কোনো ঝামেলা মেটানোর জন্য আমার কাছে চলে আসতো। আমি যেভাবে মেটাতাম তারা সকলে আমার প্রতি সন্তুষ্ট থাকতো এবং খুশি হয়ে আমার জন্য বাড়ি থেকে খাবার নিয়ে আসতো। আমি সেই খাবারগুলো ফেরত দিতাম।। হাই স্কুলে গিয়ে দেখি ছেলেরা বেশ ভালোই মেয়েদের নামে বদনাম করে ইভটিজিং করে। প্রতিবাদ শুরু করে দিলাম। মাটির রাস্তা বর্ষাকালে প্রচুর কাদা হতো ছেলেরা কাদা লাফিয়ে লাফিয়ে সকল মেয়েদের গায়ে কাদা দিতো। গ্রীষ্মকালে ছেলেরা মেয়েদের জন্য পথের জঙ্গলে লুকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতো মেয়েরা এলে ধুলা উড়াতো। আমি কোনো রকমে ক্লাস সিক্সের ৬ মাস হয়ে গেলে আমি এর প্রতিবাদ করি। চরফ্যাশন থেকে নেতাগোছের কিছু ছেলেরা এসে স্কুল পড়ুয়া মেয়েদের বাড়ি দিনরাত কাটানো শুরু করে দিল। তাদের ইচ্ছে অনুযায়ী স্কুল পড়ুয়া মেয়েদের যেখানে-সেখানে নিয়ে যেতো; ছেলেগুলো বিএনপি করতো এব্ং সেই মেয়েদের পরিবারগুলোও বিএনপি করতো। যতই ওরা বিএনপি পরিবারের হোক ওদের সাথে এক সাথে স্কুলে যেতাম এসব দেখলে আমার ভীষণ রাগ লাগতো। মাঝে মাঝেই স্কুলে যাওয়া-আসার পথে দেখি- ওরা ওই ছেলেদের সাথে রিক্সা কিংবা বাইকে সেজেগুজে কোথাও যাচ্ছে বা আসছে। এসব দৃশ্য সকলে কানাঘুষা করতো আমার বাবা শুনেও বাসায় এসে বলতো। মুক্তিযুদ্ধের সময় নারী নির্যাতনের আলোচনা তখন বাবার কাছে শুনেছি।
ক্লাস এইট পর্যন্ত দক্ষিণ আইচা হাই স্কুলে পড়াশুনা করার পর বিএনপির ছেলেদের যন্ত্রনায় স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে গেলো। বিএনপি লোকজন কর্তৃক বাবার নামে বিভিন্ন রকমের হয়রানি মিথ্যা মামলা দেওয়া শুরু হয়ে গেল। বাবাকে এলাকা থেকে দূর-দূরান্তে অজপাড়া গাঁয়ে নদী পথে বদলি করা শুরু হয়ে গেল। বাবার দোষ হলো বাবা- কোনো দলই করতো না। বিএনপির লোকদের কথা হলো- কোনো দল কেনো করবে না। বাবা বলতো- সরকারি চাকুরি করলে দল করা যায় না। বিএনপির উঠতি বয়সি নেতা ও বয়োজ্যেষ্ঠ আমাদের বাড়ি গিয়ে হুমকি দেওয়া শুরু করে। এক পর্যায়ে বাড়িতে না থাকতে পেরে আত্মীয়-স্বজনের বাড়ি বাড়ি পালিয়ে বেড়ালাম। খোঁজ নিয়ে কিছু জায়গায় গিয়েও তারা হুমকি দিলো।।কতদিন পালিয়ে থাকা যায় তারপরে বাড়ি চলে এলাম।। ক্ষমতার বড়াই দেখিয়ে বাবা-ভাইকে লোকজন দিয়ে বাড়ি থেকে অন্য জায়গায় সরিয়ে নিয়ে আমাকে শ্রীলতাহানি করলো এবং বারবার খারাপ উদ্দেশ্য নিয়ে বাড়ি এলে কৌশলে আত্মরক্ষা করেছি। তারপরে সুস্থ ও সুন্দরভাবে বাঁচতে পারবো না ভেবে আমাকে আমার বাবা ১৪ বছর ৭ মাস বয়সে ছাত্রলীগ সভাপতি’র নিকট বিয়ে দিয়েছে। তিনি সাবেক ছাত্রলীগ সভাপতি ও চরফ্যাশন সদরে তাদের বাড়ি। তিনি অজপাড়াগাঁও থেকে মাস্টারের মেয়েকে সুন্দরী দেখে এনেছিল ঘর-সংসারের দায়িত্ব দেওয়ার জন্য। অনেক ধরণের নির্যাতনের শিকার হয়ে অনেক বার আত্মহত্যার চেষ্টা করে তারপরেও গ্যাপ দিয়ে দিয়ে আমি যখন এমএ পাস করেছি তখন আমার বয়স প্রায় ৩৫ বছর পার করেছি। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে ঢাকা উত্তরা ইউনিভার্সিটি থেকে যখন পড়াশোনা করি তখনই একটা চাকরি নিয়েছিলাম। এরই মধ্যে আমি বাংলাদেশ মহিলা আওয়ামী লীগের, বাংলাদেশ পৌর আওয়ামী লীগের কমিটির সদস্য হয়েছিলাম। পড়াশুনা যেহেতু শেষ শিক্ষকতো হতে পারলাম না, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কর্মী হয়ে মুজিব আদর্শবাদ নিয়ে কাজ করা শুরু করে দিলাম। শুরু হয়ে গেল অন্য ঝামেলা। আমি মানবাধিকার কর্মীর মতো মানবিক হয়ে ওঠার বিষয়গুলো বড় বড় নেতাদের সইলো না। আমাকে দলের পোস্ট পজিশন থেকে সাময়িক সরিয়ে দিল। আমি দলীয় প্রোগ্রামে যেতে না পারলেও আমি সমাজসেবাতো করতে পারি। তাই আমি সমাজসেবাকে আন্তরিকভাবে করা শুরু করে দিলাম। এবার আমাকে বাড়ি এসে আওয়ামী লীগ নেতা হত্যার হুমকি দিলো; আরো দিল আমার তিন মেধাবী সন্তানকে। তারা ইতোমধ্যে জেনে গেছে যে, আমার তিন সন্তান মেধাবী তিন সন্তানকেও হত্যার হুমকি দিলো। আমি আমার সন্তান হত্যা হয়ে যাবে এই ভয়ে সরেই গিয়েছিলাম। এরই মধ্যে তিন জন নারী হত্যা হলো। আমি থেমে থাকতে পারলাম না, জোরালো প্রতিবাদ জানালাম।হত্যাকারীরা বহাল তবিয়তে হেঁটে বেড়াতে থাকলো । আমি আছি এদেরই চাপের মুখে, এদেরই ভয় ভীতির মুখে, এরা কেউ কেউ ক্ষমতাধরদের ফাইফরমাশে দিনাতিপাত করছিল। শুনেছি, ভালো কাজ করলে প্রকৃতি প্রতিদান দেয়। আমার ডাক এলো- ঢাকার বিভিন্ন সংগঠন থেকে। আমি পালাক্রমে শেরে বাংলা গোল্ডেন অ্যাওয়ার্ড, ডঃ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ অ্যাওয়ার্ড, বঙ্গবন্ধু শান্তি পদক, অমর একুশে স্মৃতি পদকসহ বিভিন্ন অ্যাওয়ার্ডে ভূষিত হলাম। সবশেষে পেয়েছি- হোয়াইট বাংলা এবং এটিএন বাংলার যৌথ উদ্যোগে পুরো বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে থেকে সমাজসেবায় বিশেষ অবদান রাখার কারণে ৫০জন নারীকে সম্মাননা দেওয়া হবে। সেই তালিকায় নাম চলে এলো আমারও। বিভিন্ন মন্ত্রীদের হাত থেকে অ্যাওয়ার্ড ও সার্টিফিকেট নিলাম। আবারো চললো বাছাই পর্ব সেরা ১০জন যাবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার সাথে দেখা করতে। সেরা দশের তালিকাও আমার নাম চলে এলো। পরবর্তীতে তারা সময় নির্ধারণ করে প্রধানমন্ত্রীর কাছে সাক্ষাৎ করতে নিয়ে যাবে বলে আমাদেরকে তখনকার মতো যার যার গন্তব্য স্থলে চলে যাওয়ার জন্য নির্দেশ দিলেন। চলে গেলাম এলাকায়। ফাতেমা মতিন মহিলা মহাবিদ্যালয় প্রিন্সিপাল স্যার মোহাম্মদ হোসেন স্যার ফোন দিয়ে জানালো আগামীকাল কলেজে নবীনবরণ আমি যেন অবশ্যই থাকি। সকালবেলা চরফ্যাশন পৌঁছে নাস্তা করে লাল টুকটুকে শাড়ি পড়ে কলেজে গেলাম, হল রুমের নতুন পুরনো ছাত্রীসহ শিক্ষক অভিভাবক মেহমান সবাই বসে আছে। তাদের সামনে নারী শিক্ষকদেরকে দিয়ে শুরু হয়ে গেল আমাকে প্রচন্ড রকম অপমান। আমি প্রথমে অপমানের জবাব বা প্রতিবাদ করার চেষ্টা করলাম। কিন্তু পরক্ষণেই সকলের অগ্নিমূর্তি দেখতে পেয়ে থেমে গেলাম।। অপমানটা ছিল অসহনীয়। গৃহিনী মেয়েরা অনেক ধরনের অপমান শয়ে থাকে বলে আমি সেই অপমান থেকে বাঁচার জন্য একটা চাকরি নিতে এসেছিলাম। আমি সফলতা নয়, ব্যক্তিত্বে বিশ্বাসী। এলাকায় ইতোমধ্যে সকলের মাঝে ছড়িয়ে গিয়েছিল আমি সর্বদা ন্যায়ের পক্ষে কথা বলি। মানুষের কল্যাণে কাজ করি।আমি বিনিময়ে কারো কাছে থেকে এক কাপ চা পর্যন্ত খাই না। সেই আমি আমার সততার জন্যই এত বড় বড় মহান মানবদের নামে ভূষিত হয়েছি। সেই আমি কী করে আজ এত অসম্মানিত হয়েও এদেরই সাথে চাকরি করবো।। তাই কলেজ মাঠে এসে এলাকাবাসীর উদ্দেশ্যে জানিয়ে দেওয়ার জন্য আমি চাকরিটা ছেড়ে দিলাম- এতে কারো দোষ নেই। আমার এখানে ছোট পোস্ট, আমি বড় কোনো পোস্টে যেতে চেষ্টা করবো- এই বলে সামাজিক গণমাধ্যম ফেইসবুকে লাইভ করলাম। লাইভ প্রিন্সিপালসহ সবাই দেখেছেন। তাই তাদের আর আলাদা করে কোনো কিছু বলতে হয়নি কিন্তু এতে খেপে উঠলো ক্ষমতাধরগণ। আমি কেনো চাকরি নেওয়ার সময় মিউ মিউ করেছিলাম…এখন কেনো চাকরি করবো না? তারা তো মিউ মিউ শুনে অভ্যাস, তোষামোদ, চাটুকারিতা তারা পাওয়ার জন্য পরিকল্পনা করে থাকে। আজ একজন নারী কেনো বাঘের মত গর্জন দেয়! তারা ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছিল। ভারসাম্য হারিয়ে তারা আমার সদ্য নিউ টেইনে ওঠা ছেলেকে উপজেলার সাবেক ছাত্রলীগের সভাপতি সহ-সভাপতিসহ কয়েকজন মিলে ইভটিজিংয়ের দোহাই দিয়ে ছয়টা জোর বেত দিয়ে এলোপাথারি আঘাত করলো। তারপর ছেলেকে একটি কক্ষে নিয়ে তাদের পক্ষের লোকজন ডেকে মানসিক অত্যাচার করে। খবর পেয়ে আমি যখন পৌঁছলাম আমি বললাম- আমরা স্বামী-স্ত্রী দুজন উচ্চশিক্ষিত দু’জনেই চাকরি করি আমার ছেলে অন্যায় করলে প্রাথমিক অবস্থায় আমাদের জানানো উচিত ছিল । সাবেক ছাত্রলীগ সভাপতি আমাকে লাঠি দেখালো ও বললো- আওয়াজ করলে এই বেতের বাড়ি আমার গায়ে উঠবে।। আমি সেখানে বসে অনেকবার ক্ষমতাধরকে এসএমএস করে বিষয়গুলো জানালাম সে কোনো রকম রেসপন্স করলো না। খবর পেয়ে আমার স্বামীও এলো। আমার স্বামী সাবেক ছাত্রলীগের সভাপতি উচ্চ শিক্ষিত বেসরকারি চাকরি করে; তাকে দেখেও তারা একটু সম্মান দেখালো না। আমরা স্বামী-স্ত্রী দু’জন আমাদের ছেলেকে তাদের হাতে দিয়ে বললাম- যা খুশি তা করুন, আমাদের কোনো আপত্তি নেই, রেখে গেলাম। আমি ভোলা-৪ আসনের ক্ষমতাধরকে সব জানানোর পরেও তিনি চুপ করে রইলেন। আমজনতা না বুঝলেও আমিতো জানি- এসব কে করাচ্ছেন? আমি মনে মনে সৃষ্টিকর্তার দ্বিতীয় রূপ ভেবে যাকে শ্রদ্ধা করতাম তাকে বর্তমানে বুঝতে পেরে আমার বড্ড হাসি পেলো…।
থানা থেকে ওসি আমাকে ফোন দিয়ে ছেলেকে নিতে বললো। আমি না করে দিলাম। আমি বললাম আপনার উচিত- স্বেচ্ছায় পদ থেকে সরে যাওয়া; আপনার লজ্জা করে না, অন্যায়কে অন্যায় বলতে পারেন না! কেনো দায়িত্ব নিয়ে বসে আছেন। তারপর থানা ইনচার্জ আমার স্বামীকে ফোন দিলো এবং আমার স্বামীর কাছে আমার ছেলেকে লোকমারফতে পাঠিয়ে দিল। অগণিত সাংবাদিক সংবাদ প্রকাশ করলো। সেই ক্ষমতাধর আমার স্বামীকে আওয়ামীলীগ অফিসে নিয়ে আটকে রেখে ভয়-ভীতি দেখালো; আমার সাথে তারা বসবে, সংবাদ প্রকাশ করা বন্ধ করতে বললো। আমি বললাম- আমি পৌর আওয়ামী লীগের মহিলা বিষয়ক সম্পাদক আমাকে সবাই চিনে কথা বললে আমাকে বলুন; পেরিয়ে গেলো চার থেকে পাঁচ দিন। কেউ আমার সাথে যোগাযোগ করলো না। আমি সাংবাদিক সম্মেলন করতে চেয়েছি, আমার স্বামী আমাকে বললো- ক্ষমতাধরদের কোনো বিষয়ে কোনো কথা মিডিয়াতে বললে আমার ঘরে তোমার জায়গা হবে না। আমি আর বিষয়টি মিডিয়াতে আনলাম না। ক্ষমতাধর আমাকে প্রতিপক্ষ ভেবে এত নির্যাতন করেছে। অথচ এর আগে তার সঙ্গে আমার ভালো সখ্যতা ছিল। সেই কথাগুলো ভেবে কৃতজ্ঞতা থেকে আর মিডিয়াতে আনবো না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। কিন্তু অন্যায় দেখলে, আমি থেমে থাকতে পারবো না। আবারো তাদের সাথে লেগে যাবে। অন্যদিকে তারা এবার আমার চরিত্র নিয়ে দোষ দেবে; সেজন্য আমি সেদিনই চরফ্যাশন ত্যাগ করে দুই ছেলেকে নিয়ে ঢাকা চলে এসেছি। মেয়ে আগে থেকে ঢাকায় পড়াশুনা করতো, সে আর্কিটেকচার। ঢাকায় বাসা ভাড়া নিয়ে ছেলেদের স্কুলে যখন ভর্তি করালাম স্বামী এলো, আমার পাশে দাঁড়ালো। তবে মজার বিষয় হলো- বর্তমানে যেখানেই যাই শুনতে পাচ্ছি- সকল ক্ষমতাধরদের কাছে আমার নাম বাজেভাবে উপস্থাপন করা। আমি এখন শুধুই হাসি, কত সুন্দর সিন্ডিকেট! আমি অবাক বিস্ময়! কে ভাবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কথা? কে ভাবে দেশের কথা? সবাই নিজেকে গুছাতে ব্যস্ত! এভাবেই ঝরে যায় ত্যাগী আওয়ামী লীগ। এভাবেই ঝরে যায় প্রকৃত দেশপ্রেমিক।
লেখিকা : শিক্ষানুরাগী, সমাজসেবক ও রাজনীতিবিদ