২০১০ সালে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি আইন পাস করে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। আইনটি ‘বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের বিশেষ আইন’ হিসেবে পরিচিত। ওই সময়ের পর এ আইনের আওতায় করা চুক্তির মাধ্যমে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের মেগা প্রকল্পসহ অনেক প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়েছে। চলমান রয়েছে আরো কয়েকটি প্রকল্প। বর্তমানে এ আইনের আওতায় সম্পাদিত চুক্তিগুলো পর্যালোচনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। এজন্য হাইকোর্ট বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মঈনুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের একটি জাতীয় কমিটি করা হয়েছে। এ নিয়ে ৫ সেপ্টেম্বর একটি প্রজ্ঞাপন জারি করেছে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়। পরে মন্ত্রণালয় থেকে এ-সংক্রান্ত একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তিও পাঠানো হয়।
সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মঈনুল ইসলাম চৌধুরীকে জাতীয় কমিটির আহ্বায়ক করা হয়েছে। কমিটির অন্য চার সদস্য হলেন- বুয়েটের ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক আবদুল হাসিব চৌধুরী, কেপিএমজি বাংলাদেশের সাবেক সিওও আলী আশরাফ, বিশ্বব্যাংকের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন এবং ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের ফ্যাকাল্টি অব ল অ্যান্ড সোশ্যাল সায়েন্সের অধ্যাপক মোশতাক হোসেন খান। কমিটির কার্যপরিধি সম্পর্কে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, জাতীয় কমিটি যেকোনো সূত্র থেকে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ এবং প্রয়োজনীয় যেকোনো নথি নিরীক্ষা করতে পারবে। কমিটি সংশ্লিষ্ট যেকোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে শুনানিতে আহ্বান করতে পারবে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি আইন ২০১০ (সংশোধিত ২০২১)-এর আওতায় এরই মধ্যে সম্পাদিত চুক্তিগুলোয় সরকারের স্বার্থ সংরক্ষিত হয়েছে কী-না; তা নিরীক্ষা করবে। এ নিরীক্ষার ভিত্তিতে পরবর্তী কার্যক্রমের বিষয়ে সুপারিশ প্রণয়ন করা হবে। কমিটিকে সাচিবিক ও আনুষঙ্গিক সহায়তা দেবে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়।
বিশেষ এ আইন প্রণয়নের সময় বলা হয়েছিল, দেশে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সংকট কাটাতে এটি করা হচ্ছে। যদিও সে সময় থেকেই আইনটি নিয়ে তীব্র সমালোচনা চলছে। দুই বছরের জন্য করা এ আইনের মেয়াদ তিন দফা বাড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে ২০২৬ সাল পর্যন্ত। এতে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের কেনাকাটা ও অবকাঠামো নির্মাণে কোনো অনিয়মের অভিযোগ নিয়ে আদালতে যাওয়ার কোনো সুযোগ রাখা হয়নি। যে কারণে এটিকে এ খাতের দায়মুক্তি আইন হিসেবে অভিহিত করা হয়।
অভিযোগ রয়েছে, এ আইনের আওতায় বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে অনেকগুলো অন্যায্য চুক্তি সম্পাদন হয়েছে, যার সুবিধা নিয়েছেন আওয়ামী লীগ সরকারসংশ্লিষ্ট ও ক্ষমতাঘনিষ্ঠ অনেকেই। তারা বিপুল পরিমাণ অর্থ মুনাফা করলেও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত। যদিও আইনটির সুবাদে সংশ্লিষ্ট কাউকেই এতদিন জবাবদিহিতার আওতায় আনা সম্ভব হয়নি। আইনটির আওতায় গৃহীত প্রকল্পগুলোর চুক্তি পর্যালোচনায় জাতীয় কমিটি গঠনকে স্বাগত জানিয়েছেন দেশের বিশেষজ্ঞমহল। তাদের ভাষ্যমতে, এটি এখন সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত। কারণ বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের এসব চুক্তিতে কী ছিল সেটি জানার অধিকার জনগণের রয়েছে। এ বিষয়ে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের সাবেক অধ্যাপক ইজাজ হোসেন বলেন, এসব চুক্তি পর্যালোচনার জন্য সরকার যে উদ্যোগ নিয়েছে, সেটি অবশ্যই ভালো উদ্যোগ। কারণ এটি না করলে আমরা আসলে বুঝতে পারছি না চুক্তিগুলোয় কী হয়েছে।
বিদ্যুতের নীতি ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার সেলের তথ্য অনুযায়ী, দেশে এখন বিদ্যুৎ কেন্দ্র আছে ১৫২টি। এর মধ্যে আওয়ামী লীগের ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত শাসনামলে নির্মাণ হয়েছে ১২৫টি। এগুলোর মধ্যে বিশেষ আইনের আওতায় নির্মাণ হয়েছে ৯১টি। এ আইনের আওতায়ই ২০১০ সালের দিকে দেশে ব্যাপক মাত্রায় কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র অনুমোদন দেওয়া হয়। তিন থেকে পাঁচ বছর মেয়াদি এসব বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু রাখা হয় ১০ থেকে ১৫ বছর। এমনকি গত দেড় দশকে বেসরকারি খাতে এ আইনের আওতায় কোনো ধরনের প্রতিযোগিতা ছাড়াই বেসরকারি বিদ্যুৎ উদ্যোক্তাদের প্রকল্প দেওয়া হয়েছে। এতে বিদ্যুতের উৎপাদন সক্ষমতা বাড়লেও বছরের পর বছর আর্থিকভাবে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি)। বিদ্যুৎ খাত নিয়ে ২০২২ সালের আগস্টে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ হয়। এতে দেখানো হয়, বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উদ্যোক্তাদের সঙ্গে যোগসাজশে উচ্চ মূল্যে বিদ্যুৎ কেনায় প্রতি বছর রাষ্ট্রের আর্থিক ক্ষতি হয় প্রায় ১ বিলিয়ন (১০০ কোটি) ডলার। ২০০৪ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে ৫৮টি বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে কেনা বিদ্যুতের মূল্য পর্যালোচনার ভিত্তিতে ওই গবেষণায় আরো বলা হয়, কিছু বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সঙ্গে প্রতিযোগিতামূলক চুক্তি না করায় বিদ্যুৎ খাতে ব্যয় বেড়েছে বিপুল পরিমাণে। এসব বিদ্যুৎ কেন্দ্রকে ভর্তুকি হিসেবে শুধু সরকারি জমি ইজারা দেওয়ার কারণেই বিদ্যুতের দাম ১৫ শতাংশ বেড়ে যায় বলে উল্লেখ করা হয়। ব্যয়বহুল রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর সঙ্গে সরকারের চুক্তি অনুযায়ী তাদের বিদ্যুৎ উৎপাদনের আদেশ না থাকলেও ক্যাপাসিটি চার্জ হিসেবে উৎপাদন সক্ষমতার ৬০ শতাংশ ধরে পরিশোধ করতে হয়। ক্যাপাসিটি চার্জের সুবিধা থাকায় বিদ্যুৎ উৎপাদন না করলেই বরং তাদের মুনাফা বেশি হয়।
জ্বালানি খাতে বিশেষ আইনের আওতায় বিভিন্ন সময় এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ, গ্যাসের কূপ খনন, পাইপলাইন নির্মাণ, যন্ত্রাংশ ক্রয়সহ বিভিন্ন প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। তবে এর মোট সংখ্যা সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য জানা যায়নি। এর মধ্যে গ্যাস কূপ খননের প্রকল্প আছে ৪৬টি। অভিযোগ আছে, এসব প্রকল্পে চীন-রাশিয়ার বিভিন্ন কোম্পানিকে উচ্চ দামে গ্যাসকূপ খননের কাজ দেওয়া হয়েছে।
অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় এসে গত ১৮ আগস্ট বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি বিশেষ বিধান স্থগিত করে। বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন আইন ৩৪ (ক) বিলুপ্ত করে অধ্যাদেশ জারি করা হয়। এর মধ্য দিয়ে গণশুনানির মাধ্যমে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনকে (বিইআরসি) গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম নির্ধারণের ক্ষমতা ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে।