২১ নভেম্বর ২০২৪, এখন সময় দুপুর ১:২৭ মিনিট
শিরোনাম
  1. অন্যান্য
  2. অর্থনীতি
  3. আইন-আদালত
  4. আন্তর্জাতিক
  5. কৃষি
  6. খুলনা
  7. খেলাধূলা
  8. গণমাধ্যম
  9. চট্রগ্রাম
  10. জাতীয়
  11. ঢাকা
  12. তথ্য-প্রযুক্তি
  13. ধর্মতত্ত্ব
  14. প্রকৃতি-পরিবেশ
  15. প্রবাস জীবন

ব্যবসা-বাণিজ্য স্থবির, বাড়ছে ঋণ খেলাপি

প্রতিবেদক
এ কে নাহিদ
নভেম্বর ১১, ২০২৪ ৫:১৩ অপরাহ্ণ

দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যে কয়েক মাস ধরে এক ধরনের অচলাবস্থা চলছে। অন্তর্র্বতী সরকারের ক্ষমতা গ্রহণের আগ থেকেই চলা এই স্থবিরতা এখন আরও দীর্ঘায়িত হয়েছে। একদিকে বন্ধ হচ্ছে একের পর এক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান অপরদিকে বাড়ছে খেলাপি ঋণের পরিমাণ তথা ঋণ খেলাপির সংখ্যা। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, ব্যবসা-বাণিজ্য স্থবির, বাড়ছে ঋণ খেলাপি। এসব নিয়েই
এবারের টাইমওয়াচ প্রচ্ছদ প্রতিবেদন; লিখেছেন এ কে নাহিদ
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, ঋণের টাকা ব্যাংকে ফেরত আসছে কম। শুধু তাই নয়, এক বছরে ব্যাংকিং খাতে ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদের পরিমাণ বেড়েছে এক লাখ কোটি টাকার বেশি। বাংলাদেশ ব্যাংকের ফাইন্যান্সিয়াল স্ট্যাবিলিটি রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে- ২০২৩ সালের শেষে ব্যাংকগুলোর দুর্দশাগ্রস্ত বা ঝুঁকিপূর্ণ ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪ লাখ ৭৫ হাজার কোটি টাকা। এই ঋণের মধ্যে আছে খেলাপি ঋণ, পুনঃতফসিল করা ঋণ ও রাইট-অব ঋণ। তবে চলতি বছরের জুনে এর পরিমাণ আরও অন্তত এক লাখ কোটি টাকা বাড়তি যোগ হবে। কারণ বিদায়ী সরকারের শেষ সময়ে ব্যাংক থেকে পানির গ্রোতের মতো টাকা বের করে নেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সদ্য প্রকাশিত ২০২৩ সালের আর্থিক স্থিতিশীলতা মূল্যায়ন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২২ সালের শেষে ব্যাংকিং খাতে ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদের পরিমাণ ছিল ৩.৭৮ লাখ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক বছরে ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদের পরিমাণ বেড়েছে ১.০৯ লাখ কোটি টাকা। অবশ্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাত এবং অন্যান্য বৈশ্বিক ও অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জের মতো ইস্যুগুলো ঋণগ্রহীতাদের ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা কমাতে পারে। ফলে সামগ্রিক ব্যাংকিং খাতের সম্পদের মানের অবনতি হতে পারে।
ব্যাংকাররা বলছেন, আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ সময়ে ব্যাংক খাতে ব্যাপক হারে লুটপাট হয়েছে। এস আলমসহ অনেক প্রভাবশালী গ্রুপ নামে বেনামে লাখ লাখ কোটি টাকা ঋণের নামে নিয়ে গেছে-যার বেশিরভাগই বিদেশে পাচার হয়ে গেছে। পরে এসব ঋণ খেলাপি না দেখাতে পুনঃতফসিলের করে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। পলাতক সাবেক গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের উদার নীতির কারণে ঢালাওভাবে ঋণ পুনঃতফসিল করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ওই সময় পুনঃতফসিল করা ঋণ পুনরায় খেলাপি হতে শুরু করেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর সম্প্রতি একটি অনুষ্ঠানে বলেছেন, চার-পাঁচটি পরিবার ব্যাংক থেকে দুই লাখ কোটি টাকা নিয়ে গেছে। এদিকে নতুন সরকারের ক্ষমতা গ্রহণের মাস আগস্টে ৪৬টি কোম্পানি পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে। পরের মাস সেপ্টেম্বরে বন্ধ হয়েছে আরও ২৬টি কোম্পানি। যৌথ মূলধনী কোম্পানি ও ফার্মগুলোর পরিদপ্তরের

(আরজেএসসি) তথ্য অনুযায়ী, গত ৫ মাসে (মে থেকে সেপ্টেম্বর) ১২৮টি কোম্পানি বন্ধ হয়েছে। এর মধ্যে চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে (জুলাই-সেপ্টেম্বর ) ৮৩টি কোম্পানি পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে। আগের সরকারের সুবিধাভোগী অনেক ব্যবসায়িক পৃষ্ঠপোষক ইতোমধ্যে দেশ ছেড়ে চলে গেছেন, যার ফলে ব্যবসা-বাণিজ্যের সার্বিক পরিস্থিতি স্থবির অবস্থায় রয়েছে। শুধু তাই নয়, শ্রমিক অসন্তোষের কারণে ইতোমধ্যে বন্ধ ছিল ২ শতাধিক পোশাক কারখানার উৎপাদন। বিজিএমইএ’র তথ্য বলছে- সাভার, আশুলিয়া ও গাজীপুরে সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরে শ্রমিক অসন্তোষের কারণে পোশাকশিল্পে আনুমানিক প্রায় ৪০০ মিলিয়ন ডলারের ক্ষতি হয়েছে। তৈরি পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ’র পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির কারণে কিছু অর্ডার চলে গেছে প্রতিযোগী দেশগুলোতে। সংগঠনটির সংশ্লিষ্টসূত্রে জানা গেছে, তৈরি পোশাক শিল্প ভালো নেই। প্রতিযোগী দেশগুলো থেকে পিছিয়ে পড়েছে। বিশ্বে আমাদের পোশাক আমদানি কমে আসছে। চলতি বছরের জানুয়ারি-আগস্ট সময়ে যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক আমদানির পরিমাণ বেড়েছে ১ দশমিক ৫ শতাংশ। অথচ বাংলাদেশ থেকে কমে গেছে ৩ দশমিক ৮ শতাংশ। কিন্তু চীন থেকে রপ্তানি বেড়েছে ৩ দশমিক ৬ শতাংশ। একইভাবে ভিয়েতনাম থেকে বেড়েছে ৫ দশমিক ২ শতাংশ, ভারত থেকে বেড়েছে ৭ দশমিক ৬ শতাংশ এবং কম্বোডিয়া থেকে বেড়েছে ৭ দশমিক ৭ শতাংশ।
ইউরোপে জানুয়ারি-জুলাই সময়ে মোট আমদানি বেড়েছে ৩ দশমিক ৩ শতাংশ। সেখানে বাংলাদেশ থেকে বেড়েছে মাত্র ২ দশমিক ৮ শতাংশ। কিন্তু চীন থেকে বেড়েছে ৬ দশমিক ৪ শতাংশ, ভারত থেকে বেড়েছে ৫ দশমিক ১৮ শতাংশ, কম্বোডিয়া থেকে বেড়েছে ১৮ দশমিক ৩৫ শতাংশ, ভিয়েতনাম থেকে বেড়েছে ১২ দশমিক ৬১ শতাংশ এবং পাকিস্তান থেকে বেড়েছে ১৪ দশমিক ৪১ শতাংশ। আর তুলনামূলক রপ্তানি প্রবৃদ্ধির বিচারে চলতি বছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে বাংলাদেশের রপ্তানি প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৫ দশমিক ৩৪ শতাংশ। আর ভিয়েতনামের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৫ দশমিক ৫৭ শতাংশ এবং ভারতের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৩ দশমিক ৪৫ শতাংশ। অর্থাৎ এই বছরের তৃতীয় প্রান্তিকে আমাদের প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় প্রবৃদ্ধিতে অনেকটাই পিছিয়ে পড়েছে। যেটি এসব দেশে রপ্তানি আদেশ শিফট হয়ে যাওয়াকে ইঙ্গিত করে।
সূত্রে আরও জানা গেছে, সাম্প্রতিক সময়ে নির্দিষ্ট কিছু শিল্পাঞ্চলে অস্থিরতার কারণে শুধু সেপ্টেম্বর মাসে এই খাতে প্রায় ২৫০-৩০০ মিলিয়ন ডলারের রপ্তানি ও উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে।’ বিশ্লেষকরা বলছেন, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে কিছু কোম্পানির ব্যবসা করার সুযোগ সীমিত হয়ে গেছে। এছাড়া মূল্যস্ফীতির চাপে উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি, বিক্রি কমে যাওয়া, সুদের উচ্চ হার, শ্রম অসন্তোষ, পরিবহন ও কারিগরি সমস্যা, ডলার সংকটে কাঁচামালের ঘাটতি, বৈশ্বিক যুদ্ধ ও আকস্মিক বন্যার বিরূপ প্রভাব মোকাবিলা করতে হচ্ছে ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তাদের।
দেশের বিভিন্ন কোম্পানির তথ্যানুযায়ী, পরিচালনা পর্ষদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী-স্থায়ীভাবেই প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এরইমধ্যে ১৬০টির মতো কোম্পানি বন্ধের প্রক্রিয়াও এগিয়ে চলছে। বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান আরজেএসসিতে বন্ধের আবেদনসহ প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট জমা দিয়েছে। আবার কিছু কোম্পানি সাধারণ সভার বৈঠকে প্রতিষ্ঠান বন্ধের সিদ্ধান্ত জানিয়েছে। বন্ধের তালিকায় ছোট প্রতিষ্ঠান যেমন রয়েছে, তেমনই বড় গ্রুপের প্রতিষ্ঠানও রয়েছে। যৌথ মূলধনী কোম্পানি ও ফার্মগুলোর পরিদপ্তরে নিবন্ধিত এসব কোম্পানির মধ্যে পণ্য সরবরাহ ও সেবাদানকারী উভয় খাতের প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এছাড়া নতুন বিনিয়োগের পরিকল্পনা নিয়ে নিবন্ধন নেওয়া কোম্পানিও বন্ধের তালিকায় আছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, ২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রায় ১৫ লাখ কোটি টাকা মোট ঋণের প্রায় ৩২ শতাংশই দুর্দশাগ্রস্ত ঋণ ছিল। এই পরিসংখ্যান আগের বছরের তুলনায় প্রায় এক লাখ কোটি টাকা বা ২৬ শতাংশ বেশি। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ব্যাংকিং খাতে বর্তমানে ঋণের পরিমাণ প্রায় ১৬ লাখ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপির পরিমাণ মোট বিতরণকৃত ঋণের ১২ শতাংশের কম। তবে এস আলম গ্রুপের ঋণসহ বড় ঋণগুলো বিবেচনায় নিলে খেলাপি ঋণের হার ২০ শতাংশ হয়ে যেতে পারে।
দেশের বিভিন্ন ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ (এনপিএল) ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে জানা যায়, দেশের শিল্প উদ্যোক্তারা এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি ঋণ পুনঃতফসিল করেছেন। ২০২৩ সালের শেষে পুনঃতফসিলকৃত ঋণ স্থিতির ২৬ দশমিক ৪ শতাংশই ছিল শিল্প খাতের। দ্বিতীয় স্থানে ছিল বস্ত্র ও তৈরি পোশাক খাত। এই খাতের উদ্যোক্তারা ২০ দশমিক ৯ শতাংশ ঋণ পুনঃতফসিল করেছেন। এছাড়া পুনঃতফসিলকৃত ঋণের ১১ দশমিক ৩ শতাংশ চলতি মূলধন, ব্যবসায়িক ১১ শতাংশ, আমদানি ৮ দশমিক ৭ শতাংশ, ৬ দশমিক ৫ শতাংশ নির্মাণ, ৫ দশমিক ২ শতাংশ কৃষি খাতে এবং ৫ দশমিক ৫ শতাংশ অন্যান্য খাতে। ব্যাংকগুলো সর্বশেষ ২০২৩ সালে ৯১ হাজার ২২১ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ পুনঃ তফসিল করেছে। পুনঃতফসিল করা এই অঙ্ক এক বছরের হিসাবে এযাবৎকালে সর্বোচ্চ। এছাড়া ২০২৩ সালের শেষে ব্যাংক খাতের পুনঃতফসিলকৃত ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৮৮ হাজার ৫৪০ কোটি টাকা, যা ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা মোট ঋণের ১৮ দশমিক ৭৫ শতাংশ। পুনঃতফসিল করা ঋণের সঙ্গে খেলাপি ও অবলোপন করা ঋণ যোগ করলে মন্দ ঋণের পরিমাণ দাঁড়াবে ৫ লাখ কোটি টাকা। এর সঙ্গে অনেক ব্যাংকের পরিচালকদের নেওয়া ঋণ বিবেচনায় নিলে প্রকৃত পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হবে বলে বিশ্লেষকদের ধারণা। এই প্রসঙ্গে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেনের ভাষ্যমতে, আদালতের স্থগিতাদেশের কারণে যে খেলাপি ঋণ হিসাব করা হয়নি, সেগুলো এর সঙ্গে যোগ করা হলে মন্দ ঋণ আরও বেশি হতো।’ তিনি জানান, একদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সমর্থনে লুটপাট হয়েছে, অপরদিকে বড় ঋণগ্রহীতারা তাদের প্রভাব খাটিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক চ্যানেলের মাধ্যমে ঋণ সুবিধা নিয়েছে, কিন্তু ফেরত দেয়নি। ফলে ব্যাংকগুলো এখন চাপে পড়েছে।’ এদিকে যাচাই-বাছাই না করে ঋণ বিতরণ করায় বেশ কয়েকটি ব্যাংক এখন চাপে পড়েছে। কয়েকটি ব্যাংক আমানতকারীদের টাকা সময়মতো ফেরত দিতে পারছে না। এছাড়া দেশের ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতেও খেলাপি ঋণ বেড়েই চলেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত তিন মাসে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর খেলাপি ঋণ ৮২২ কোটি টাকা বেড়েছে। গত জুনের শেষে মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে হয়েছে প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা, যা এই খাতে বিতরণ করা মোট ঋণের ৩৩.১৫ শতাংশ। বলতে গেলে, এরই আলোকে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য স্থবির হয়ে পড়েছে।পাশাপাশি বেড়েই চলেছে ঋণ খেলাপি। ফলে দেশের অর্থনীতি দিন দিন হুমকিতে পড়ছে। অর্থনীতির এই ক্লান্তিকাল অতিক্রম করতে অবশ্যই জোড়ালো উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। দেশের সামগ্রিক অর্থনীতি গতিশীল হোক; এটিই আমাদের একমাত্র প্রত্যাশা।

 

সর্বশেষ - আইন-আদালত