তুরস্কে জাহাজ রফতানি করছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের বেসরকারি জাহাজ নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ‘আনন্দ শিপইয়ার্ড’ তুরস্কে সাড়ে পাঁচ হাজার ডেডওয়েট টনের (ডিডব্লিউটি) অত্যাধুনিক বহুমুখী জাহাজ ‘ওয়েস ওয়্যার’ রফতানি করতে যাচ্ছে।
তুরস্কে জাহাজ রফতানি করছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের বেসরকারি জাহাজ নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ‘আনন্দ শিপইয়ার্ড’ তুরস্কে সাড়ে পাঁচ হাজার ডেডওয়েট টনের (ডিডব্লিউটি) অত্যাধুনিক বহুমুখী জাহাজ ‘ওয়েস ওয়্যার’ রফতানি করতে যাচ্ছে। আজ জাহাজটি আনুষ্ঠানিকভাবে তুরস্কের বিখ্যাত কোম্পানি ‘নোপ্যাক শিপিং অ্যান্ড ট্রেডিং লিমিটেড’র কাছে হস্তান্তর করা হবে।
একে জাহাজ রফতানিতে সুদিনের হাতছানি হিসেবে দেখছেন সংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে, এর মাধ্যমে ২০০৮ সালে দেশ থেকে জাহাজ রফতানি শুরু হওয়ার পর করোনা মহামারীসহ নানা প্রতিকূলতা পেরিয়ে ফের রফতানিতে নিয়মিত হওয়ার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। তাছাড়া ‘ওয়েস ওয়্যার’ নামের এ জাহাজটি এ পর্যন্ত রফতানি হওয়া জাহাজগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় এবং প্রযুক্তিগতভাবে সবচেয়ে উন্নত, যা দেশে রফতানিমুখী জাহাজ নির্মাণ শিল্পে সক্ষমতা বৃদ্ধির প্রতীক। এতে বাংলাদেশ থেকে আরো দেশ জাহাজ নিতে আগ্রহী হবে।
আজকের জাহাজ হস্তান্তর অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার কথা রয়েছে নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয় এবং শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেনের। এ সময় শিল্প মন্ত্রণালয় এবং গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান এবং বাংলাদেশে তুরস্কের রাষ্ট্রদূত রমিজ সেন উপস্থিত থাকবেন বলেও কথা রয়েছে।
বাংলাদেশের ‘সবচেয়ে বড়’ জাহাজ রফতানিকারক প্রতিষ্ঠান আনন্দ শিপইয়ার্ড সূত্রে জানা গেছে, উন্নত নকশা ও আন্তর্জাতিক মানের প্রযুক্তি দিয়ে তৈরি করা হয়েছে ‘ওয়েস ওয়্যার’। জাহাজটির দৈর্ঘ্য ৩৪১ ফুট, প্রস্থ ৫৫ ফুট ও গভীরতা ২৫ ফুট। এটি একটি ২ হাজার ৭৩৫ হর্স পাওয়ার বা অশ্বশক্তি ইঞ্জিন দ্বারা চালিত। এটি প্রতি ঘণ্টায় ১২ নট গতিতে ৫ হাজার ৫০০ টন পণ্য বহন করতে সক্ষম। জাহাজটি ইস্পাতের কয়েল, কয়লা, সার, খাদ্যশস্য এবং রাসায়নিক পদার্থসহ বিভিন্ন ধরনের পণ্যসামগ্রী পরিবহনের জন্য উপযুক্ত।
এর আগে ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে কোম্পানিটি যুক্তরাজ্যভিত্তিক এনজিয়ান শিপিং কোম্পানি লিমিটেডে ৬ হাজার ১০০ ডিডব্লিউটি জাহাজ রফতানি করে, যা সে সময় বাংলাদেশ থেকে রফতানি করা সবচেয়ে বড় জাহাজগুলোর মধ্যে একটি ছিল।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে জাহাজ তৈরি শিল্প স্বয়ংসম্পূর্ণ হলে গভীর সমুদ্রে মাছ ধরে তা রফতানি করে বছরে ২ বিলিয়ন ডলার আয়ের পথ তৈরি সম্ভব। এছাড়া গভীর সমুদ্রে রাসায়নিক কারখানা স্থাপন করে জলজ উদ্ভিদ ও সামুদ্রিক শৈবাল থেকে ওষুধ কারখানার জন্য কাঁচামাল সরবরাহ সম্ভব। ফলে দেশের ওষুধ শিল্পের কাঁচামাল আমদানি কমবে ও বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় হবে।
আনন্দ শিপইয়ার্ডের কর্মকর্তারা জানান, বাংলাদেশের জাহাজ নির্মাণ শিল্পে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আসছে প্রতিষ্ঠানটি। আজ অবধি তারা দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক উভয় ক্লায়েন্টদের কাছে ৩৫০টিরও বেশি জাহাজ সরবরাহ করেছে। ২০০৮ সালে আনন্দ শিপইয়ার্ড ডেনমার্কে কনটেইনার জাহাজ ‘স্টেলা মেরিস’ রফতানির মাধ্যমে সমুদ্রগামী জাহাজ রফতানিকারক হিসেবে প্রথম আত্মপ্রকাশ করে। তারপর থেকে জার্মানি, নরওয়ে, মোজাম্বিক, যুক্তরাজ্য এবং অন্যান্য দেশে রফতানি করা হয়েছে।
প্রতিষ্ঠানটির কারিগরি পরিচালক ড. নাজমা নওরোজ জানান, জাহাজটির নির্মাণকাজ শেষে সব মেশিনারি টেস্ট ট্রায়াল কাজ সম্পন্ন। সি ট্রায়াল শেষ হওয়ায় জাহাজটিকে ক্রেতার কাছে বুঝিয়ে দিতেই অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। তিনি বলেন, ‘জাহাজ নির্মাণ শিল্প খাতকে বিভিন্ন সুবিধাদি দেয়া শুধু সময়ের দাবি নয়, বরং একাধিক রফতানি খাতে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ একান্ত প্রয়োজন। জাহাজ নির্মাণ শিল্প ব্লু-ইকোনমির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খাত এবং এর উন্নয়ন ছাড়া ব্লু-ইকোনমি সঠিকভাবে বিকশিত হওয়া সম্ভব নয়।’
নয় লাখ বর্গফুট আয়তনের আনন্দ শিপইয়ার্ডে ড্রেজার ও প্রযুক্তিগতভাবে উন্নত জাহাজের পাশাপাশি একসঙ্গে ১০ হাজার টন পর্যন্ত দৈর্ঘ্যের আটটি জাহাজ নির্মাণের সক্ষমতা রয়েছে। সার্বক্ষণিক কার্যক্রমের মাধ্যমে শিপইয়ার্ড বাংলাদেশের জাহাজ নির্মাণ খাতে একটি গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে বলে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
আনন্দ শিপইয়ার্ড অ্যান্ড স্লিপওয়েজ লিমিটেডের চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহেল বারী বলেন, ‘২০২২ সালের পর আমরা জাহাজ রফতানি করছি। তুরস্কে যাওয়া জাহাজটি এ পর্যন্ত পাঠানো জাহাজগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় এবং প্রযুক্তিগতভাবে সবচেয়ে উন্নত ।’
তিনি বলেন, ‘আন্তর্জাতিক রীতি অনুযায়ী, একটি জাহাজের অর্থায়নের প্রায় ৮৫ শতাংশ আসে ব্যাংক গ্যারান্টির মাধ্যমে। তবে বাকি ১৫ শতাংশ, অর্থাৎ ২৫-৩০ কোটি টাকা আমাদের নিজস্ব তহবিল থেকে ব্যবস্থা করতে হয়। এত বড় পরিমাণ অর্থ সংগ্রহ করা কঠিন। কারণ ব্যাংকগুলো প্রায়ই এটি সরবরাহ করতে অনিচ্ছুক থাকে। ফলে উৎপাদনের সময় ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল আটকে থাকে, যার ফলে বিলম্ব হয়।’ তিনি আরো বলেন, ‘দেশের জাহাজ নির্মাণ খাতের অপার সম্ভাবনা থাকলেও দীর্ঘমেয়াদি ও স্বল্প সুদে অর্থায়নের অভাব এ শিল্পকে কাঙ্ক্ষিত গতিতে এগিয়ে যাওয়ার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে।’
বাংলাদেশে জাহাজ নির্মাণ: বাংলাদেশে জাহাজ নির্মাণ খাতকে সম্ভাবনাময় মনে করে ২০০৮ সালে ডেনমার্কে অত্যাধুনিক কনটেইনার জাহাজ ‘স্টেলা মেরিস’ রফতানি করে আনন্দ শিপইয়ার্ড। তাদের এ রফতানির কারণে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে উদীয়মান জাহাজ নির্মাণ জাতি হিসেবে স্বীকৃতি অর্জন করেছে। গত দেড় দশকে প্রতিষ্ঠানটি বিভিন্ন ধরনের ৩৫৬টিরও বেশি জাহাজ তৈরি করেছে। দক্ষ জনশক্তি, আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার এবং আন্তর্জাতিক মান মেনে চলা এ খাতের প্রবৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করেছে। এর মধ্যে আছে কার্গো জাহাজ, যাত্রীবাহী জাহাজ, মাল্টিপারপাস আইস-ক্লাস ভেসেল, ল্যান্ডিং ক্রাফ্ট, অফশোর প্যাট্রল ভেসেল, টাগবোট, মাছ ধরার জাহাজ, বাল্ক ক্যারিয়ার ও কনটেইনার ক্যারিয়ার। এরই মধ্যে দেশ থেকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ডেনমার্ক, জার্মানি, নরওয়ে, মোজাম্বিক ও ইউকেসহ বিভিন্ন দেশে ৫০টি জাহাজ রফতানি করেছে।
বর্তমানে দেশে ৩০টিরও বেশি বড় শিপইয়ার্ড রয়েছে। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি সরাসরি আন্তর্জাতিক বাজারে জাহাজ রফতানি করে। এশিয়ার জাহাজ নির্মাণ শিল্পে চীন, দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানের পর বাংলাদেশ ধীরে ধীরে তার উপস্থিতি জানান দিচ্ছে। মাঝারি আকারের পণ্যবাহী জাহাজ, কনটেইনার জাহাজ, ট্যাংকার ও ড্রেজার নির্মাণে সুনাম অর্জন করছে। যদিও প্রাথমিক ফোকাস অভ্যন্তরীণ চাহিদা পূরণের দিকে রয়ে গেছে, গত দশকে রফতানি উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশের প্রায় ৯০% জ্বালানি, ৭০% কার্গো এবং ৩৫% যাত্রী পরিবহন নৌপথে সম্পন্ন হয়। এ বিশাল চাহিদা মেটাতে বিভিন্ন আকারের প্রায় ৩০০ শিপইয়ার্ড স্থাপন করা হয়েছে।
বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) মতে, বর্তমানে দেশে শতাধিক জাহাজ নির্মাণ কোম্পানি এবং ১২০টিরও বেশি নিবন্ধিত শিপইয়ার্ড রয়েছে। উদ্যোক্তাদের প্রায় ৩০০টি সক্রিয় শিপইয়ার্ড রয়েছে। দেশীয় জাহাজের বাজার বার্ষিক ১০-১৫% হারে বাড়ছে, যেখানে রফতানি প্রতি বছর ৫-৬ শতাংশ হারে তুলনামূলকভাবে ধীরগতিতে বাড়ছে। দেশের স্থানীয় জাহাজ নির্মাণ শিল্পের বার্ষিক মূল্য প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার। বর্তমান সক্ষমতা দিয়ে বাংলাদেশ বছরে প্রায় ২০টি জাহাজ রফতানি করতে পারে।
