মহান আল্লাহ তাআলা হিজরি সনের যে চারটি মাসকে সম্মানিত করেছেন তাহল জিলকদ, জিলহজ, মহরম ও সফর। সম্মানিত এ চারটি মাসের মধ্যে মহরম অত্যন্ত ফজিলতপূর্ণ ও বরকতময় মাস; যে মাসকে আইয়্যামে জাহিলিয়াতের যুগের আরব্য বেদুইনরাও বিশেষ সম্মান ও মর্যাদার চোখে দেখত। আবার হিজরি সনের প্রথম মাসও মহরম। হাদিস শরিফে চান্দ্রবর্ষের বারো মাসের মধ্যে মহরমকে ‘শাহরুল হারাম’ বা ‘শাহরুল্লাহ’ (আল্লাহর মাস) বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
এই পবিত্র মাসের দশম দিনকে আশুরা বলা হয়। আরবি শব্দ ‘আশুরা’ অর্থ দশম। শাব্দিক অর্থে যে কোনো মাসের ১০ তারিখকেই আশুরা বলা যায়। কিন্তু ইসলামি শরিয়তের পরিভাষায় কেবল মহরম মাসের ১০ তারিখকেই আশুরা নামে অভিহিত করা হয়। কারো কারো মতে, এ মাসের ১০ তারিখে ১০টি তাৎপর্যবহ ঘটনা সংঘটিত হয়েছে বিধায় এ দিনকে আশুরা নামে সম্বোধন করা হয়। মুসলিম উম্মাহর জন্য এটি একটি তাৎপর্যময় ও গুরুত্ববহ দিন। ৬৮০ খ্রি. মোতাবেক ৬১ হিজরির এই দিনে অন্যায় ও ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে ইসলামের শেষ নবি হজরত মুহম্মদ (স.)-এর দৌহিত্র হজরত ইমাম হুসাইন (রা.) চক্রান্তকারী ইয়াজিদ বাহিনীর হাতে ফোরাত নদীর তীরে কারবালার প্রান্তরে মর্মান্িতকভাবে শাহাদতবরণ করেন। বিশ্বের মুসলমানদের কাছে দিনটি একদিকে যেমন শোকের, তেমনি হত্যা ও ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার চেতনায় উজ্জ্বল।
জুলুম-অবিচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো এবং অসত্য ও অন্যায় প্রতিরোধে ইমাম হুসাইন (রা.)-এর এ ভূমিকায় মানবজীবনের জন্য বিরাট একটি শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে। তবে ইসলামের ইতিহাসে কারবালার এই শোকাবহ ঘটনার আগেও এ দিনে নানা তাৎপর্যময় ঘটনা ঘটেছে। যেমন বর্ণিত আছে-
১. আল্লাহ তাআলা আকাশ জমিন পাহাড়-পর্বতসহ সমস্ত পৃথিবী এ দিনে সৃষ্টি করেন।
২. আদি মানব হজরত আদম (আ.) এই দিনে পৃথিবীতে আগমন করেন, এই দিনই তার তওবা কবুল করা হয় এবং এ দিনে তিনি স্ত্রী হাওয়া (আ.)-এর সঙ্গে আরাফার ময়দানে সাক্ষাত্ লাভ করেন।
৩. হজরত ইউনুছ (আ.) এই দিনে ৪০ দিন পর মাছের পেট থেকে আল্লাহর রহমতে মুক্তি লাভ করেন।
৪. এই দিনই হজরত নুহ (আ.)-এর নৌকা মহাপ্লাবন থেকে রক্ষা পেয়ে তুরস্কের জুদি নামক পর্বতে নোঙর করে।
৫. হজরত ইবরাহিম (আ.) নমরুদের প্রজ্বলিত অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষিপ্ত হওয়ার ৪০ দিন পর সেখান থেকে ১০ মহরম মুক্তি লাভ করেন।
৬. দীর্ঘ ১৮ বছর কঠিন রোগ ভোগের পর হজরত আইয়ব (আ.) দুরারোগ্য ব্যাধি থেকে মুক্তি লাভ করেন।
৭. হজরত ইয়াকুব (আ.)-এর পুত্র হজরত ইউসুফ (আ.) তার ১১ ভাইয়ের ষড়যন্ত্রে কূপে পতিত হন এবং পরবর্তীকালে দীর্ঘ ৪০ বছর পর ১০ মহরম তারিখে পিতার সঙ্গে সাক্ষাৎ লাভ করেন।
৮. হজরত মুসা (আ.) এই দিনে ফিরাউনের অত্যাচার থেকে নিষ্কৃতি লাভ করেন এবং অভিশপ্ত ফিরাউনকে লোহিতসাগরে ডুবিয়ে হত্যা করা হয়।
৯. এই দিনে হজরত ঈসা (আ.) জন্মগ্রহণ করেন এবং তার জাতির লোকেরা তাকে হত্যার চেষ্টা করলে আল্লাহ পাক তাকে আসমানে উঠিয়ে নিয়ে মুক্তি দান করেন।
১০. কারবালার প্রান্তরে ইমাম হুসাইন (রা.) পরিবার-পরিজনসহ শাহাদতবরণ। এছাড়া হাদিস শরিফে উল্লেখ রয়েছে, মহরম মাসের ১০ তারিখ আশুরার দিনেই কেয়ামত সংঘটিত হবে।
ইতিহাস পর্যালোচনায় জানা যায়, আমিরে মুয়াবিয়ার মৃতু্যর পর তার পুত্র ইয়াজিদ অবৈধভাবে ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য চুক্তির শর্ত ভঙ্গ করেন এবং এ জন্য ষড়যন্ত্র ও শক্তি ব্যবহারের পথ বেছে নেন। চক্রান্েতর অংশ হিসেবে মহানবি হজরত মুহম্মদ (স.)-এর আরেক দৌহিত্র হজরত ইমাম হাসান (রা.) কে বিষপান করিয়ে হত্যা করা হয়। একই চক্রান্ত ও নিষ্ঠুরতার ধারাবাহিকতায় ইয়াজিদ বাহিনীর হাতে অবরুদ্ধ হয়ে পরিবার-পরিজন ও ৭২ জন সঙ্গীসহ শাহাদত বরণ করেন হজরত ইমাম হুসাইন (রা.)। তাদের হত্যার ক্ষেত্রে যে নির্মম-নিষ্ঠুর পথ বেছে নেওয়া হয়েছে, ইতিহাসে এর নজির বিরল। অসহায় নারী ও শিশুদের পানি পর্যন্ত পান করতে দেয়নি ইয়াজিদ বাহিনী। বিষাক্ত তিরের আঘাতে নিজের কোলে থাকা শিশুপুত্রের মৃতু্যর পর আহতাবস্থায় অসীম সাহসিকতার সঙ্গে লড়াই করে শহিদ হন হজরত ইমাম হুসাইন (রা.)। অন্যায় ও ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে এই আপসহীন অবস্থান ও ত্যাগের যে শিক্ষা কারবালা মানবজাতিকে দিয়েছে, তা আজকের দুনিয়ার অন্যায় ও অবিচার দূর করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে।
আশুরার দিনে অনেক আম্বিয়ায়ে কিরাম আল্লাহ পাকের সাহাঘ্য লাভ করেন এবং কঠিন বিপদ-আপদ থেকে মুক্তি লাভ করেন। এই সাহাঘ্যের শুকরিয়া হিসেবে নবি-রসুলগণ এবং তাদের উম্মতগণ এ দিনে রোজা পালন করতেন। এ দিনে উম্মতে মুহাম্মদি হিসেবে বিশেষ নেক আমল করা অত্যন্ত সাওয়াবের কাজ। মহরম মাসে তথা মহরমের ১০ তারিখে (পবিত্র আশুরার দিন) রোজা রাখা সম্পর্কে অনেক বিশুদ্ধ হাদিস বর্ণিত হয়েছে। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসুলুল্লাহ (স.) আশুরা ও রমজানের রোজা সম্পর্কে যেরূপ গুরুত্ব প্রদান করতেন, অন্য কোনো রোজা সম্পর্কে সেরূপ গুরুত্বারোপ করতেন না। (সহিহ বুখারি ১/২১৮) অন্য এক হাদিসে নবি (স.) বলেছেন, আশুরার রোজার ব্যাপারে আমি আশাবাদী, আল্লাহ তাআলা এ অসিলায় অতীতের এক বছরের গুনাহ ক্ষমা করে দেবেন। (মুসনাদে আহমদ ও তিরমিজি শরিফ)।
মোদ্দা কথা, মহরমের শিক্ষা হলো অন্যায়-দুরাচারের বিরুদ্ধে আদর্শিক সংগ্রাম পরিচালনা করার শিক্ষা। জালিমের বিরুদ্ধে মাজলুমের অকুতো ভয় লড়াইয়ের সাহস সঞ্চার করার শিক্ষা। তাই বিশ্ব মুসলিমের কাছে উদাত্ত আহ্বান আসুন এই পবিত্রতম দিনে ইবাদত-বন্দেগিতে মশগুল হয়ে আল্লাহ্র সন্তুষ্টি অর্জন করতে সচেষ্ট হই এবং ইমাম হুসাইন (রা.)-এর আদর্শকে বুকে ধারণ করে অন্যায়-জুলুমের বিরুদ্ধে আওয়াজ বুলন্দ করি।
লেখক: কবি, প্রাবন্ধিক ও সহ. অধ্যাপক, শেরপুর সরকারি মহিলা কলেজ, শেরপুর