পারিবারিক ব্যবসা প্রজন্মের পর প্রজন্ম টিকিয়ে রাখতে হলে পরিবার ও ব্যবসা আলাদা করতে হবে। ব্যবসা পরিচালনার দায়িত্বে রাখতে হবে পেশাদার ও অভিজ্ঞদের। আর মালিক বা শেয়ারধারীদের থাকতে হবে পেছনের আসনে। শুধু তা–ই নয়, পারিবারিক ব্যবসায় উত্তরাধিকার হিসেবে সন্তানদেরও নেতৃত্বে আনতে হবে যোগ্যতার ভিত্তিতে। পাশাপাশি ডিজিটাল রূপান্তরেও সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এমসিসিআই) আয়োজিত ‘যেখানে পারিবারিক মূল্যবোধ মিলে যায় ভবিষ্যৎ দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে : টেকসই উত্তরাধিকার কৌশল’ শীর্ষক সেমিনারে বক্তারা এসব কথা বলেন। তারা বলেন, টেকসই পারিবারিক ব্যবসার জন্য পারিবারিক মূল্যবোধ খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
রাজধানীর গুলশানে এমসিসিআইয়ের কার্যালয়ে ২ সেপ্টেম্বর আয়োজিত সেমিনারে উপস্থিত ছিলেন- বাংলাদেশের সফল দুই পারিবারিক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান—ইস্পাহানি গ্রুপের এম এম ইস্পাহানি লিমিটেডের চেয়ারম্যান মির্জা সালমান ইস্পাহানি ও স্কয়ার গ্রুপের প্রতিষ্ঠান স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তপন চৌধুরী। তারা নিজেদের পারিবারিক ব্যবসা পরিচালনার অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন এমসিসিআইয়ের সভাপতি কামরান টি রহমান।
সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সিঙ্গাপুরের বেসরকারি প্রতিষ্ঠান রাজাহ অ্যান্ড ট্যানের এক্সিকিউটিভ কমিটি পার্টনার আব্দুল জব্বার বিন কারাম দীন। তিনি বলেন, পারিবারিক ব্যবসায় ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে হলে পরিবার ও ব্যবসা পুরোপুরি আলাদা করতে হবে। পারিবারিক শাসনকাঠামো প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের পাশাপাশি পারিবারিক ব্যবসার উত্তরাধিকারও নির্ধারণ করতে হবে। তিনি পারিবারিক ব্যবসা পরিচালনায় একটি পারিবারিক কার্যালয় (ফ্যামিলি ফার্ম) স্থাপনেরও পরামর্শ দেন। যেটি হবে পরিবারের উদ্যোগে একটি ব্যক্তিগত সম্পদ ব্যবস্থাপনা পরামর্শক প্রতিষ্ঠান। যারা পরিবারের সম্পদ ও বিনিয়োগের দৈনন্দিন প্রশাসনিক কার্যক্রম ও ব্যবস্থাপনা তদারকি করবে।
২০৫ বছরের বেশি সময়ের পারিবারিক ব্যবসায়িক ঐতিহ্য ইস্পাহানি গ্রুপের। সেই গ্রুপের নেতৃত্বে থাকা মির্জা সালমান ইস্পাহানি বলেন, শেয়ার থাকলেই কেউ নেতৃত্ব পাবেন, এমন ধারণা ভুল। ব্যবসা পরিচালনার ক্ষেত্রে দক্ষতা, অভিজ্ঞতা ও সঠিক শিক্ষা থাকাটাই গুরুত্বপূর্ণ। তাই উত্তরাধিকার পরিকল্পনা তৈরি করা অপরিহার্য। কেবল বড় ছেলে বা মেয়ে বলে দায়িত্ব দেওয়া ঠিক নয়। তিনি আরও বলেন, ‘প্রথমে একক মালিকানায় ব্যবসা হলেও পরিবারের পরিধি বাড়লে শুধু আত্মীয়স্বজন দিয়ে পরিচালনা করা সম্ভব হয় না। তখন পেশাদার ব্যবস্থাপনা বাধ্যতামূলক হয়ে ওঠে। আমাদের প্রতিষ্ঠান বহু বছর ধরে পেশাদারি ভিত্তিতে পরিচালিত হচ্ছে।’
মির্জা সালমান ইস্পাহানি বলেন, ‘ব্যবসা পরিচালনায় পেশাদার ব্যবস্থাপকদের দায়িত্ব দিয়ে শেয়ারধারীদের পেছনের আসনে বসতে হবে। ব্যবসায়িক ইউনিটের দৈনন্দিন পরিচালনা, নিয়োগ, বরখাস্ত, ছুটি, ইনক্রিমেন্ট দেওয়া ইত্যাদি বিষয় পেশাদারদের কাছে ছেড়ে দিতে হবে। তারা শেয়ারধারীদের চেয়ে অনেক ভালোভাবে সেগুলো সামলাবে। আমি আমার বন্ধুদের বলি, আমার সত্যি কোনো কাজ নেই। যখন অফিসে যাই তখন কেউ আমার সঙ্গে কথা বলতে আসেন না। আমি হাঁটতে হাঁটতে বলি, কী হচ্ছে? তাঁরা (কর্মীরা) বলেন, আপনি বোর্ড সভায় শুনবেন।’
স্কয়ার ফার্মার এমডি তপন চৌধুরী নিজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বলেন, ব্যবসায় যোগ দেওয়ার পর প্রথমে বাবার সঙ্গে কাজ করেছেন তিনি। সে সময় দেখেছেন, কীভাবে প্রতিষ্ঠান চালাতে হয়। একবার তাদের পারিবারিক এক বন্ধু নৈশভোজে বাসায় এসেছিলেন। খাবারের আগে তিনি হঠাৎ বললেন, ‘আপনার ছেলে এত কাজ করছে, কেন তাকে ব্যবস্থাপনা পরিচালক বানাচ্ছেন না? এটা আমার জন্য খুবই বিব্রতকর ছিল। কারণ, আমাদের সংস্কৃতিতে বাবার সামনে এমন প্রস্তাব দেওয়া যায় না।’ স্কয়ারের কর্মীরাও পরিবারের মতো হয়ে গেছেন বলে মন্তব্য করেন তপন চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘আমরা এখন বেশ কয়েকটি কোম্পানি চালাচ্ছি। পেশাদারেরা সেগুলো পরিচালনা করছেন। আপনি যদি বিশ্বের সবচেয়ে সফল কোম্পানির দিকে তাকান, তাহলে একই জিনিস দেখতে পাবেন।’
দেশের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় শিল্পগোষ্ঠী এসিআইয়ের চেয়ারম্যান আনিস উদ দৌলা স্মরণ করিয়ে দেন যে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানকে ক্রমাগত পরিবর্তিত হতে হবে। তিনি বলেন, ‘একটি বিষয় উপলব্ধি করতে হবে যে প্রতিষ্ঠান আজ যে আকারে আছে, ভবিষ্যতে তা একই রকম থাকবে না।’
এমসিসিআইয়ের সভাপতি কামরান টি রহমান বলেন, স্পষ্ট কৌশলের অভাবে অনেক সময় পারিবারিক ব্যবসায় ভাঙন ও অস্থিরতা দেখা দেয়। এমনকি দীর্ঘদিন ধরে গড়ে ওঠা ব্যবসার বিলুপ্তি পর্যন্ত হয়। এটি ভাগ্য নয়, প্রস্তুতির বিষয়। সুগঠিত উত্তরাধিকার পরিকল্পনা পরিবারকে তাদের মূল্যবোধ ও দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্য আনতে সাহায্য করে। এটাও স্বীকার করতে হবে, সবার জন্য এক রকম পদ্ধতি কার্যকর হবে না। প্রতিটি পরিবারের ভেতরের গতিশীলতা, ব্যবসার বিশেষ চাহিদা ও অর্থনীতির পরিবর্তনশীল প্রেক্ষাপটে এটিকে মানিয়ে নিতে হয়।
সেমিনারে আরও বক্তব্য দেন এএজেড অ্যান্ড পার্টনার্সের ম্যানেজিং পার্টনার্স আনিস এ খান। মুক্ত আলোচনায় অংশ নিয়ে কথা বলেন প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের পরিচালক উজমা চৌধুরী।