চতুর্থ শিল্প বিপ্লব (৪ওজ) এমন এক ধরনের ইন্ডাস্ট্রিজ, সার্ভিস ও প্রশাসন সৃষ্টির পথ খুলে দিয়েছে যেখানে কায়িক শ্রমিকদের চাহিদা দ্রæত কমছে। ভবিষ্যতের নিকট সময়ে রুটিন কাজগুলো মেশিনের মাধ্যমে সম্পন্ন হবে-এমনটাই ধারণা করা হচ্ছে। ফলে এসব খাতে শ্রমশক্তির প্রাসঙ্গিকতা কমতে পারে বলে যে আশঙ্কা করা হচ্ছে, তা মূলত স্বয়ংক্রিয়তা, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) এবং অন্যান্য উন্নত প্রযুক্তির রূপান্তরমূলক প্রভাব থেকে উদ্ভূত। যদিও এ উদ্বেগ যুক্তিসংগত, তবে শ্রমবাজার সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত না হয়ে কীভাবে পরিবর্তিত হতে পারে সে বিষয়ে গভীরভাবে বিবেচনা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বিশেষ করে বাংলাদেশে, যেখানে জনসংখ্যা প্রায় ১৮০ মিলিয়ন, তার মধ্যে ১৫-২৪ বছর বয়সী প্রায় ৫৪ মিলিয়ন তরুণ রয়েছে, যারা কর্মজীবনে প্রবেশের অপেক্ষায়। প্রতি বছর এ দেশে দুই থেকে ২ দশমিক ২ মিলিয়ন তরুণ শ্রমবাজারে প্রবেশ করে। অন্যদিকে শ্রমশক্তির একটি উল্লেখযোগ্য অংশ অদক্ষ বা কম দক্ষ হওয়ার কারণে বৈশ্বিক শ্রমবাজারে বাংলাদেশের অবস্থান সংকুচিত হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে দ্রæত প্রযুক্তিগত অগ্রগতি, বৈশ্বিক বাজারের আন্তঃসংযুক্ততা এবং প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার প্রয়াসে বাংলাদেশ বিচ্ছিন্নভাবে টিকে থাকতে পারবে না। এসব প্রেক্ষাপটে, দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে লক্ষ্যভিত্তিক অর্থনৈতিক ও শিক্ষাগত সংস্কার এখন সময়ের দাবি।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ৪ওজ-এর সুযোগগুলো কাজে লাগানোর জন্য বিভিন্ন পন্থা অবলম্বন করেছে, যা তাদের নিজস্ব ইতিহাস, সম্পদ ও কৌশলগত অগ্রাধিকারের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। বাংলাদেশের জানা দরকার যে এশীয় দেশগুলো কীভাবে এসব সুযোগের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করতে অভিযোজনশীল নীতিমালা গ্রহণ করেছে।
সিঙ্গাপুর তার ছোট আকার এবং কৌশলগত অবস্থানকে কাজে লাগিয়ে শিক্ষা, গবেষণা ও উচ্চ দক্ষতাসম্পন্ন কর্মশক্তিকে কেন্দ্র করে একটি জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতি গড়ে তুলেছে। চীন নির্মাণ শিল্প এবং অবকাঠামোগত আধিপত্য থেকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, নবায়নযোগ্য জ্বালানি ও ডিজিটাল ইকোসিস্টেমের ক্ষেত্রে প্রযুক্তিগত স্বনির্ভরতার দিকে রূপান্তর করেছে। জাপান ঐতিহ্যবাহী শিল্পগুলোকে উন্নত রোবোটিকস এবং স্বয়ংক্রিয় প্রযুক্তির সঙ্গে সমন্বয় করে উচ্চ মূল্যের উৎপাদন এবং প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনে বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা ধরে রেখেছে। ভারত আইটি ও ডিজিটাল সার্ভিস প্রসারকে শ্রমশক্তির দক্ষতা উন্নয়ন এবং অবকাঠামো উন্নয়নের উদ্যোগের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে পরিচালনা করছে।
এ উদাহরণগুলো দেখায় যে চতুর্থ শিল্প বিপ্লব যুগে অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য কোনো সর্বজনীন মডেল নেই; প্রতিটি দেশকে তাদের স্থানীয় অগ্রাধিকার এবং বৈশ্বিক সুযোগের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রেখে নিজস্ব প্রেক্ষাপটনির্ভর কৌশল প্রণয়ন করতে হবে। ঘনবসতিপূর্ণ একটি উন্নয়নশীল দেশ ও ক্রমবর্ধমান যুব জনগোষ্ঠীর অধিকারী বাংলাদেশ এমন কিছু স্বতন্ত্র চ্যালেঞ্জ ও সুযোগের মুখোমুখি, যা একটি প্রাসঙ্গিক এবং লক্ষ্যভিত্তিক কৌশলগত দৃষ্টিভঙ্গি দাবি করে। যুব জনগোষ্ঠীর এই ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডকে কাজে লাগাতে হলে তথ্যপ্রযুক্তি, সাইবার নিরাপত্তা, ডিজিটাল মার্কেটিং, ই-কমার্স, বিজনেস অ্যানালিস্ট, বøকচেইন ডেভেলপার, নবায়নযোগ্য জ্বালানি ও হালকা প্রকৌশলসহ উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জনকারী খাতগুলোয় দক্ষতা উন্নয়নে অগ্রাধিকার দিতে হবে।
বর্তমানে কৃষি, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ, তৈরি পোশাক (আরএমজি), আইসিটি/সফটওয়্যার, ওষুধ, চামড়াজাত পণ্য, পাটজাত পণ্য এবং হালকা প্রকৌশল খাতগুলো দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি চালিত করছে। এ শ্রমনির্ভর শিল্পগুলোর উৎপাদনশীলতা বাড়াতে ধীরে ধীরে অটোমেশন অন্তর্ভুক্ত করতে হবে, যাতে আকস্মিকভাবে কর্মসংস্থান হারিয়ে যাওয়ার শঙ্কা না থাকে। তবে ঐতিহ্যবাহী শিল্পগুলোর ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা দেশের দ্রæত পরিবর্তনশীল বৈশ্বিক অর্থনীতির সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর ক্ষমতাকে সীমিত করে।
বাংলাদেশের জন্য জরুরি অগ্রাধিকারগুলোর মধ্যে রয়েছে শিল্প খাতের বৈচিত্র্যকরণ, স্টার্টআপ ও ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগগুলোকে (এসএমইএস) উৎসাহিত করা এবং স্থানীয় গবেষণা ও উন্নয়নে (আরঅ্যান্ডডি) বিনিয়োগ করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই), ইন্টারনেট অব থিংস (আইওটি) এবং সবুজ প্রযুক্তির মতো আধুনিক খাতে স্থানীয় দক্ষতা তৈরি করা। বাংলাদেশকে এমন উদ্ভাবনী নীতিমালা গ্রহণ করতে হবে, যা স্থানীয় সমস্যার সমাধানে মনোযোগ দেয়, যেমন টেকসই কৃষি, দুর্যোগ সহনশীলতা ও নগরায়ণ। পুঁজি ও প্রাকৃতিক সম্পদের সীমাবদ্ধতার কারণে বাংলাদেশকে ভারী শিল্প উৎপাদন এবং মৌলিক গবেষণার পরিবর্তে প্রয়োগভিত্তিক উদ্ভাবনী গবেষণায় অগ্রাধিকার দিতে হবে।
বৃহৎ জনসংখ্যার কারণে একটি উচ্চ দক্ষতাসম্পন্ন কর্মশক্তি তৈরির দিকে বিশেষ মনোযোগ দিতে হবে, যা উদ্ভাবনী পরিবর্তন সাধনে এবং আন্তর্জাতিক শ্রমবাজার দখলে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। এ দক্ষ শ্রমশক্তি তৈরি করতে হলে বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে অবশ্যই উন্নত করতে হবে। এর মূল ভিত্তি হবে সেই ধরনের শিক্ষা নির্ধারণ করা, যা কর্মশক্তিকে ৪ওজ-এর জন্য কার্যকরভাবে প্রস্তুত করতে সক্ষম।
ফরাসি চিন্তাবিদ রেনে দেকার্তের যুক্তিবাদী দার্শনিকতায় গভীরভাবে প্রভাবিত ঐতিহ্যবাহী শিক্ষককেন্দ্রিক শিক্ষা মডেল চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের রূপান্তরমূলক চাহিদা পূরণে আর যথেষ্ট নয়। দেকার্তের দ্বৈতবাদী দর্শন, যা মন ও শরীরকে আলাদা করে দেখায়, একটি যুক্তিবাদী শিক্ষা মডেলের ভিত্তি স্থাপন করেছিল, যেখানে বৌদ্ধিক যুক্তি প্রাধান্য পায় এবং সংবেদনশীল বা আবেগীয় অভিজ্ঞতাকে উপেক্ষা করা হয়। যৌক্তিক যুক্তির প্রয়োগ এবং বিষয়ভিত্তিক বিশেষায়ণকে গুরুত্ব দিয়ে এ পদ্ধতি উচ্চ শিক্ষাকে এককালীন প্রক্রিয়া হিসেবে দেখেছে, যেখানে শিক্ষকরা জ্ঞানের সরবরাহকারী এবং শিক্ষার্থীরা জ্ঞানের প্যাসিভ গ্রহণকারী। যদিও এটি একটি মৌলিক ভিত্তি প্রদান করেছে, ডেকার্টীয় মডেল ৪ওজ-এর গতিশীল চাহিদা মেটাতে যথেষ্ট নয়। জন ডিউই, পাওলো ফ্রেইরে, রুডলফ স্টেইনার, কার্ল রজার্স, জাঁ পিয়াজে এবং বেল হুকসের মতো চিন্তাবিদরা বিকল্প পদ্ধতির পক্ষে মত দিয়েছেন, যা শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক, আন্তঃবিষয়ক এবং প্রাসঙ্গিক সম্পৃক্ততাকে গুরুত্ব দেয়। এ কাঠামো শিক্ষার্থীদের জন্য ডিজিটাল সাক্ষরতা, আবেগীয় বুদ্ধিমত্তা, সমালোচনামূলক চিন্তাশক্তি, সৃজনশীলতা, সমস্যা সমাধানের দক্ষতা, সহানুভূতি, সহযোগিতা এবং অভিযোজনযোগ্যতার মতো ৪ওজ-এর জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জনে সহায়তা করে।
দেকার্তীয় কাঠামোর কঠোরতাকে এই অ-দেকার্তীয় মডেলের সঙ্গে একীভূত করা বিষয়ভিত্তিক বিশেষায়নের পাশাপাশি উদ্ভাবনকেও ভারসাম্যপূর্ণ করতে পারে, যা স্নাতকদের অরৈখিক কর্মজীবন ও উদীয়মান ভূমিকার জন্য প্রস্তুত করবে।
বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এই একীকরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। শিক্ষকদের উচিত পরিবর্তনের প্রতি ঐতিহ্যগত প্রতিরোধের মানসিকতা থেকে সরে আসা এবং উচ্চ শিক্ষায় প্রয়োজনীয় সংস্কার বাস্তবায়নে অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করা, যা উদ্যমী ও প্রাণবন্ত তরুণ প্রজন্মের জন্য উপকারী হবে।
বাংলাদেশ বর্তমানে এক গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে। প্রয়োজনীয় পরিবর্তনে বিলম্ব অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ বাড়িয়ে তুলবে এবং বৈশ্বিক অর্থনীতিতে সম্ভাবনাগুলো হাতছাড়া করার ঝুঁকি তৈরি করবে। ইন্ডাস্ট্রিজে বৈচিত্র্য আনয়ন, শিক্ষার আধুনিকীকরণ এবং উদ্ভাবনের প্রসার ঘটিয়ে বাংলাদেশ চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের যুগে একটি স্থিতিশীল ও সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে পারে। পদক্ষেপ নেয়ার সময় এখনই।