দেশের বিভিন্ন মহলের নানা আলোচনা-সমালোচনার মধ্যেও দুই নৌ টার্মিনাল পরিচালনা নিয়ে চুক্তি সই হয়েছে। এরই আলোকে চট্টগ্রামের পতেঙ্গায় কর্ণফুলী নদীর তীরে লালদিয়া টার্মিনাল নির্মাণ ও পরিচালনা নিয়ে একটি এবং ঢাকার অদূরে কেরানীগঞ্জের পানগাঁও নৌ টার্মিনাল পরিচালনার বিষয়ে অন্য চুক্তিটি হয়। ১৭ নভেম্বর ঢাকার একটি হোটেলে আয়োজিত পৃথক দুই অনুষ্ঠানে চুক্তি দুইটি সই হয়েছে। এই চুক্তির স্বাক্ষর প্রকাশ্যে হলেও চুক্তিতে বিস্তারিত কী কী শর্ত রয়েছে এবং কী কী তথ্য প্রকাশ করা যাবে না, সেগুলো আনুষ্ঠানিকভাবে গণমাধ্যমকে জানানো হয়নি। নৌপরিবহন উপদেষ্টা বলেছেন, চুক্তির বিভিন্ন শর্তের বিষয়ে পরবর্তী সময়ে জানানো হবে।
চট্টগ্রাম বন্দরের লালদিয়া কনটেইনার টার্মিনাল নিয়ে করা চুক্তিতে সই করেন ডেনমার্কভিত্তিক এপিএম টার্মিনালসের ভাইস প্রেসিডেন্ট মার্টেইন ভ্যান ডোঙ্গেন ও চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এস এম মনিরুজ্জামান। এ সময় ডেনমার্কের পক্ষে উপস্থিত ছিলেন আইবিএস এপিএম টার্মিনালসের হেড অব ইনভেস্টমেন্ট ভাস্কর সেনগুপ্ত, ডেনমার্কের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের স্টেট সেক্রেটারি লিনা গান্ডলোসে হ্যানসেন ও বাংলাদেশে ডেনমার্কের রাষ্ট্রদূত ক্রিশ্চিয়ান ব্রিকস মোলার। এতে বাংলাদেশের পক্ষে নৌপরিবহন উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন, প্রধান উপদেষ্টার আন্তর্জাতিক বিষয়সংক্রান্ত বিশেষ দূত লুৎফে সিদ্দিকী, পিপিপি কর্তৃপক্ষের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুন (আশিক চৌধুরী) ও নৌপরিবহন সচিব নুরুন্নাহার চৌধুরী উপস্থিত ছিলেন। অন্যদিকে পানগাঁও নৌ টার্মিনালবিষয়ক চুক্তিতে সই করেন চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এস এম মনিরুজ্জামান ও মেডলগ বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এ টি এম আনিসুল মিল্লাত। এখানেও নৌপরিবহন উপদেষ্টা উপস্থিত ছিলেন।
চুক্তি অনুযায়ী চট্টগ্রাম বন্দরের লালদিয়া কনটেইনার টার্মিনাল নির্মাণ এবং ৩০ বছরের জন্য এটি পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছে ডেনমার্কের এপি মোলার মায়ের্সক গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান এপিএম টার্মিনালস। সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বের (পিপিপি) আওতায় এ টার্মিনাল নির্মাণের জন্য কোম্পানিটি ৫৫ কোটি ডলার বা প্রায় ৬ হাজার ৭০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করবে। চুক্তিটি স্বাক্ষরের পরপরই ২৫০ কোটি টাকা ‘সাইনিং মানি’ হিসেবে পেয়েছে বাংলাদেশ। অন্যদিকে ২২ বছরের জন্য ঢাকার কেরানীগঞ্জের পানগাঁও নৌ টার্মিনাল পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছে সুইজারল্যান্ডের প্রতিষ্ঠান মেডলগ এসএর হাতে। এ টার্মিনালে মোট ৪ কোটি ডলার বা প্রায় ৪৯০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করবে মেডলগ। এ ক্ষেত্রে সাইনিং মানি হিসেবে তারা বাংলাদেশকে দিয়েছে ১৮ কোটি টাকা।
অনুষ্ঠানে জানানো হয়, চট্টগ্রামের লালদিয়া টার্মিনালে বছরে আট থেকে দশ লাখ একক কনটেইনার ওঠানো–নামানোর সক্ষমতা থাকবে। এর মধ্যে আট লাখ পর্যন্ত প্রতি একক কনটেইনারে ২১ ডলার (প্রায় ২ হাজার ৫০০ টাকা) করে পাবে সরকার। আর আট লাখের বেশি কনটেইনার ওঠানো–নামানো হলে প্রতি একক কনটেইনারের জন্য পাবে ২৩ ডলার করে। অন্যদিকে নারায়ণগঞ্জের পানগাঁও নৌ টার্মিনালে বছরে ১ লাখ ৬০ হাজার একক কনটেইনার হ্যান্ডলিং হবে বলে জানিয়েছে মেডলগ। প্রতি একক কনটেইনার থেকে ২৫০ টাকা করে পাবে সরকার।
চট্টগ্রামের লালদিয়া টার্মিনালের চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে নৌপরিবহন উপদেষ্টা এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, এই চুক্তি বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে জাতির জন্য বড় অবদান। যাদের মধ্যে চুক্তি নিয়ে সন্দেহ ছিল, আশা করি তা দূর হবে। পিপিপি কর্তৃপক্ষের সিইও আশিক চৌধুরী বলেন, লালদিয়া দেখিয়ে দিয়েছে পিপিপি শুধু তত্ত্বে নয়, বাস্তবেও কার্যকর। ভবিষ্যতেও আমরা বাস্তবায়নকেন্দ্রিক অবকাঠামো উন্নয়নেই মনোযোগ দেব। এ সময় আগামী কয়েক বছরে চারটি নতুন বন্দর বাস্তবায়নের কাজ সম্পন্ন হবে বলে জানান তিনি। অনুষ্ঠানে ভার্চ্যুয়ালি যুক্ত হয়ে ডেনমার্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী লার্স লোক্কে রাসমুসেন বলেন, গত পাঁচ দশকে বাংলাদেশের অন্যতম উন্নয়ন সহযোগী ছিল ডেনমার্ক। এখন সেই সম্পর্ক সহায়তা থেকে ব্যবসায়ে রূপ নিয়েছে। বন্দর পরিচালনার দায়িত্ব পাওয়া মায়ের্সক লাইনের চেয়ারম্যান রবার্ট মেয়ার্স্ক উগলা বলেন, লালদিয়া হবে অত্যাধুনিক গ্রিনফিল্ড টার্মিনাল; সেখানে নিরাপত্তা, অটোমেশন ও স্থায়িত্বের সর্বোচ্চ মান থাকবে। এতে বাংলাদেশের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বাড়বে। নৌপরিবহন উপদেষ্টা সাখাওয়াত হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, যারা চুক্তির ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারছেন না, তাদের আমি অনুরোধ করবো- আপনারা ব্যাপারটা ভালো করে বোঝেন। বিরোধিতা করতে কোনো অসুবিধা নেই। তবে দেশের জন্য, ভবিষ্যতের জন্য কী করছি, তা আমাদের চিন্তা করতে হবে বলে জানান তিনি।


















