দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ১২ শতাংশ ছুঁই ছুঁই করছে। খাদ্যের মূল্যস্ফীতি আরও বেশি—১৪ দশমিক ১০ শতাংশ। মূল্যস্ফীতির এই চিত্র ১৩ বছর ৪ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। ঠিক এ রকম সময়েই বাংলাদেশ ব্যাংকের ১৩তম গভর্নরের দায়িত্ব পেয়েছেন বিশিষ্ট গবেষক আহসান এইচ মনসুর। ১৩ আগস্ট রাত ১০টা ৪০ মিনিটে এ বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে।
শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পাঁচ দিন পরপর ১০ আগস্ট পদত্যাগ করেন গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার। তিনি যোগ দিয়েছিলেন ২০২২ সালের ১২ জুলাই। দুই বছরের বেশি সময়ে ব্যাংক খাতের দুর্নীতি, অনিয়ম, খেলাপি ঋণ ও অর্থ পাচার রোধ এবং ডলার-সংকটের সমাধানে ব্যর্থতাসহ নানা কারণে তাঁর নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভূমিকা সমালোচনার মুখে ছিল।
সর্বোচ্চ বয়সসীমা ৬৭ বছর নির্দিষ্ট থাকায় বিদ্যমান বাংলাদেশ ব্যাংক অর্ডার অনুযায়ী আহসান এইচ মনসুর গভর্নর পদে নিয়োগ পেতে পারেন না। কারণ, তার বয়স এখন ৭২ বছর ৮ মাস। সে জন্য তাকে নিয়োগ দিতে সরকারকে ওই অর্ডার সংশোধন করতে হয়েছে। এতে গভর্নর পদের বয়সসীমা তুলে দেওয়া হল। অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ ১৩ আগস্ট রাতে আহসান মনসুরকে নিয়োগ দিয়ে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। তার আগে এ বিভাগের তৈরি করা এ–সংক্রান্ত ফাইলে অনুমোদন দিয়েছেন অর্থ ও পরিকল্পনা উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ এবং অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ। অনুমোদন পাওয়ার পর আগে অধ্যাদেশ জারি হয়। পরে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর নিয়োগের প্রজ্ঞাপন জারি হয়। আগেও একবার গভর্নরের বয়সসীমা ৬৫ থেকে ৬৭ বছর করে বাংলাদেশ ব্যাংক অর্ডার সংশোধন করা হয় সাবেক গভর্নর ফজলে কবিরের জন্য, যা ছিল দেশের ইতিহাসে প্রথম ঘটনা। দেশের মুদ্রা সরবরাহ কত হবে, টাকার মান কতটা বাড়বে, মূল্যস্ফীতির হার কত রাখা হবে- এ সবই ঠিক করেন গভর্নর। দেশের মানুষের জীবনযাপনের মান, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান তার সিদ্ধান্তের ওপরই নির্ভর করে অনেকটা। কোনো দেশই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর পদের জন্য রাজনৈতিক পরিচয় বা সমর্থনকে খুব বেশি গুরুত্ব দেয় না, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতাকেই বিবেচনা করা হয়।
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর বর্ণাঢ্য কর্মজীবনের অধিকারী। তিনি ১৯৭৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক সম্পন্ন করেন। পরের বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। তিনি ১৯৭৭ সালে ম্যাকমাস্টার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। আর ১৯৮২ সালে ওয়েস্টার্ন অন্টারিও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করেন। তিনি ১৯৮১ সালে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলে যোগদান করেন। তিনি ১৯৮৩ থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের ফিসকাল অ্যাফেয়ার্স বিভাগে কাজ করেছেন। তিনি ১৯৮৯ সালে অর্থমন্ত্রী ওয়াহিদুল হকের অর্থ উপদেষ্টা নিযুক্ত হন এবং ১৯৯১ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ১৯৯৬ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত, তিনি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের মধ্যপ্রাচ্য ও মধ্য এশিয়া বিভাগে দায়িত্ব পালন করেন।
আগে যারা গভর্নর ছিলেন
স্বাধীনতার পর থেকে বর্তমান পর্যন্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংকে মোট ১২ জন গভর্নর নিয়োগ দিয়েছে সরকার, যাদের বেশির ভাগই আমলা। তবে প্রথম গভর্নর আ ন ম হামিদুল্লাহ (১৯৭২-৭৪) ছিলেন একজন ব্যাংকার। দ্বিতীয় গভর্নর এ কে নাজিরউদ্দীন আহমেদের (১৯৭৪-৭৬) বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলে (আইএমএফ) কাজ করার অভিজ্ঞতা ছিল। তৃতীয় গভর্নর এম নূরুল ইসলাম (১৯৭৬-৮৭) ছিলেন পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসের (সিএসপি) কর্মকর্তা এবং তিনিই প্রথম আমলা গভর্নর।
চতুর্থ গভর্নর ছিলেন কর ক্যাডারের কর্মকর্তা শেগুফ্তা বখ্ত চৌধুরী (১৯৮৭-৯২)। পঞ্চম গভর্নর এম খোরশেদ আলমও (১৯৯২-৯৬) ছিলেন একজন সিএসপি কর্মকর্তা। ষষ্ঠ গভর্নর হিসেবে নিয়োগ পান ব্যাংকার লুৎফর রহমান সরকার (১৯৯৬-৯৮)। সপ্তম গভর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন (১৯৯৮-২০০১) অর্থনীতির শিক্ষক ও আমলা। অষ্টম গভর্নর ফখরুদ্দীন আহমদ (২০০১-০৫) অর্থনীতির শিক্ষক, আমলা ও বিশ্বব্যাংকের কর্মকর্তা ছিলেন। নবম গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদও (২০০৫-০৯) ছিলেন তা–ই। তিনি তিন সরকারের (বিএনপি, তত্ত্বাবধায়ক ও আওয়ামী লীগ) আমলের গভর্নর। দশম গভর্নর আতিউর রহমান (২০০৯-১৬) একজন অর্থনীতিবিদ ও শিক্ষক। একাদশ গভর্নর ফজলে কবির (২০১৬-২২) এবং দ্বাদশ গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারও আমলা ছিলেন।