আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সংস্কার কার্যক্রম শুরু করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডেও (এনবিআর) এর ঢেউ লেগেছে। গত ৯ অক্টোবর এনবিআরের সাবেক দুই চেয়ারম্যান ও সাবেক তিন সদস্যকে সঙ্গে নিয়ে যাত্রা শুরু করেছে এনবিআর সংস্কারে পরামর্শক কমিটি। ইতোমধ্যে সময়ে এনবিআর কর্মকর্তা, ব্যবসায় সংগঠনের প্রতিনিধি ও অন্যদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন কমিটির সদস্যরা। সংগ্রহ করা হচ্ছে বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত। রাজস্ব আদায়ে স্বচ্ছতা, আইনের স্পষ্টতা দূরীকরণ ও ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিতে সুপারিশ করবে এই কমিটি। তবে কমিটির সুপারিশ আমলে নেওয়া ও না নেওয়া এখন বিবেচ্য বিষয়।
জানা গেছে, সরকারকে এই কমিটি রাজস্ব নীতি, রাজস্ব প্রশাসন, এনবিআরের প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতার মূল্যায়ন ও আধুনিকায়ন, শুদ্ধাচার ও সুশাসনের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো ও নীতিমালা প্রণয়ন, নাগরিক যোগাযোগ ও অংশীজন সম্পৃক্ততার কার্যক্রম এবং রাজস্ব সংস্কার সংশ্লিষ্ট যেকোনো নীতিগত পরামর্শ দেবে। পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট এই পরামর্শক কমিটির সদস্যরা হলেন- এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান মো. আব্দুল মজিদ ও নাসিরউদ্দিন আহমেদ, এনবিআরের সাবেক সদস্য মো. দেলোয়ার হোসেন (কর), ফরিদ উদ্দিন (শুল্ক) ও আমিনুর রহমান (কর)।
এনবিআর সংস্কার পরামর্শক কমিটি সূত্রে জানা গেছে, অংশীজনদের সঙ্গে তাদের বৈঠক চলছে। ব্যবসায়ী প্রতিনিধিরা তাদের সমস্যার কথা তুলে ধরছেন। করদাতারা হয়রানি ও কর প্রদানে জটিলতার কথা জানিয়েছেন। এনবিআরের দাবি- করদাতাদের মধ্যে ফাঁকির প্রবণতা বেশি। এই দুটির মধ্যে সমন্বয় করতে হবে। সংস্কার পরামর্শক কমিটি এটি নিয়ে কাজ করছি।
কর গ্রহণে এনবিআর কর্মকর্তাদের অসহযোহিতা ও হয়রানির অভিযোগ আছে। ব্যক্তি শ্রেণির করদাতাদের পাশাপাশি শুল্ক ভ্যাট আদায়ে এনবিআর কর্মকর্তাদের অসহযোগিতার কথা বলেন ব্যবসায়ীরা। অন্যদিকে এনবিআর কর্মকর্তাদের দাবি, হয়রানি বলে ব্যবসায়ীরা অনেক আওয়াজ তুলেন। কিন্তু কোথাও তারা অভিযোগ করেন না। ব্যবসায়ীদের ফাঁকির প্রবণতা বন্ধ করতে কঠোর হতে হয় এনবিআরকে। এই কঠোরতাকে হয়রানি বলা হয়।
এনবিআরের নতুন চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান দায়িত্ব নেওয়ার পর হয়রানিমুক্ত এনবিআর উপহার দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। সেই লক্ষ্যে এনবিআরে অটোমেশন করার কথা জানিয়েছেন তিনি। চলতি অর্থবছর ব্যক্তিশ্রেণির করদাতাদের অনলাইনে রিটার্ন প্রদান বাধ্যতামূলক করেছেন। রিটার্নের নথিপত্র জমায় এনেছেন শিথিলতা। যদিও ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, পণ্য আমদানি ও রপ্তানিতে তারা হয়রানির শিকার হয়ে থাকেন। দেশের ব্যবসায়ী ও আয়কর রিটার্নকারীদের ভাষ্য, যখন রিটার্ন সাবমিট করতে যাই তখন নানা রকমের ভোগান্তি পোহাতে হয়। আবার পণ্য আমদানিতে সামান্য ক্ল্যারিকাল মিসটেকে অনেক জরিমানা করা হয়।
দেশের ব্যবসায়ীরা মনে করেন, কিছু দিন পরপর আইন ও বিধির পরিবর্তন করা হয়, এটা ব্যবসায়ীদের জন্য উদ্বেগের। কিছুদিন পরপর এইচএস কোডের পরিবর্তন ব্যবসায়ীদের ঝামেলায় ফেলে। সংস্কার প্রস্তাবে এসবের প্রতিকার থাকতে হবে। এছাড়া অজ্ঞতা ও হয়রানির আশঙ্কায় অনেকেই রিটার্ন জমা দেন না। অটোমেশনের মাধ্যমে রিটার্ন আদায় বাড়ানো সম্ভব। সংস্কার প্রস্তাবে এই বিষয়গুলো উঠে আসা উচিত বলে মনে করেন তারা।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড করদাতা ও ভ্যাটদাতার যে তথ্য প্রদান করে সেটা বাস্তবতা বিবর্জিত বলে মনে করেন দেশের বিশিষ্টজন। তাদের মতে, এ তথ্যের স্পষ্টতা ও সঠিকতা না থাকলে এনবিআর যেমন লক্ষ্য অর্জন করতে পারবে না, তেমনি দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির উন্নতি হবে না। অনুসন্ধানে জানা গেছে, ভ্যাট রেজিস্ট্রেশন আছে পাঁচ লাখের মতো। বাজেট বক্তব্যে বলা হয়েছে- ২৪ হাজার ইলেকট্রনিক ফিসক্যাল ডিভাইস (ইএফডি) বসানো হয়েছে। কিন্তু এনবিআর জানালো মাত্র ১১ হাজার বসানো হয়েছে। ৪২ লাখ রিটার্ন জমা হয়েছে বিগত অর্থবছরে। এসব রিটার্নের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো জিরো রিটার্ন। আরেকটা বড় অংশ হলো- সরকারি চাকরিজীবীরা। বেসরকারি খাতের বড় অংশ কর জালের বাইরে। সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাবে সরকার বড় অঙ্কের রাজস্ব হারাচ্ছে।
এনবিআর সংস্কারে পরামর্শক কমিটির সদস্য এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান মো. আব্দুল মজিদ বলেন, ‘আমরা ব্যবসা-বাণিজ্যসহ রাজস্ব আহরণে সংশ্লিষ্ট অন্যান্য খাতের সঙ্গে বৈঠক করবো। শিগগিরই আমাদের প্রতিবেদন তৈরির কাজ শেষ করব।’ সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে আব্দুল মজিদ বলেন, রাজস্ব আদায়ে স্বচ্ছতা বাড়াতে হবে। এটা যদি না বাড়ে তাহলে কস্ট অব ডুয়িং বিজনেস বাড়বে। আর তা হলে মূল্যস্ফীতি বাড়বে, সিন্ডিকেশন বাড়বে। ‘২০০৭-২০০৮ সালে সংস্কারের সুযোগ এসেছিল। সেখানে অনেক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। কিন্তু দেখা গেছে পরবর্তীতে যে সরকার এসেছে তারা কোনো কিছুই অনুসরণ করেনি। তবে জাতির সামনে আমরা পরামর্শ হাজির করে যাব। আমরা সুপারিশ দিয়ে যাব। আলোচনার মাধ্যমে এই সুপারিশগুলো প্রণয়ন করে যাব।’ আব্দুল মজিদ বলেন, প্রতিবছর বাজেটের আগে এনবিআর সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে প্রস্তাব নেয়। সেগুলো আসলে কারও পড়ার সময়-সুযোগ থাকে না। অর্থ আইনে নিয়ে যাওয়ার ইচ্ছাও থাকে না। আমরা এই সাইকেলগুলো পরিবর্তন করার কথা ভাবছি।’
জানা গেছে, পরামর্শক কমিটির সঙ্গে একাধিক বৈঠক হয়েছে এনবিআরের। এসব বৈঠকে এনবিআরের শীর্ষ কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে বিগত অর্থবছরের তথ্য ও আগামী দিনের পরিকল্পনা জানতে চেয়েছে পরামর্শক কমিটি। আর কমিটিকে সর্বাত্মক সহযোগিতার কথা জানিয়েছে এনবিআর। সূত্র জানায়, রাজস্ব সংস্কার কমিটির সঙ্গে বৈঠকে এনবিআর কর্মকর্তারা দুর্নীতি রোধে টেকসই ও স্বচ্ছ অটোমেশন ব্যবস্থা বাস্তবায়নের পাশাপাশি কাস্টমস আইন, মূল্য সংযোজন কর ও সম্পূরক শুল্ক আইন এবং আয়কর আইন সংস্কারের প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানিয়েছেন। এনবিআরের এক কর্মকর্তা বলেন, সংস্কারগুলো যথাযথভাবে সম্পন্ন হলে দেশি-বিদেশি উভয় বিনিয়োগকারীর আস্থা ফিরে আসবে। বর্তমান কর আদায় ব্যবস্থাপনা পুরোপুরি স্বয়ংক্রিয় নয়। সম্পূর্ণ অটোমেশন বাস্তবায়িত হলে করদাতাদের হয়রানি উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পাবে এবং রাজস্ব আয় বৃদ্ধি পাবে।
আয়কর আইন পর্যালোচনা করতে গত অক্টোবর মাসে একটি টাস্কফোর্স গঠন করেছে এনবিআর। কর কমিশনার ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ মামুন এই টাস্কফোর্সের প্রধান। সাত সদস্যবিশিষ্ট এই টাস্কফোর্স পুরো আয়কর আইনটি পর্যালোচনা করবে। জানা গেছে, এই টাস্কফোর্স আয়কর আইন, বিধি ও প্রজ্ঞাপনগুলোর খুঁটিনাটি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করবে। এছাড়া রাজস্ব আদায়ে নতুন আইনের প্রভাবও বিশ্লেষণ করবে টাস্কফোর্স। বিভিন্ন খাতে যে কর ছাড় দেওয়া হয়েছে, এসব কর ছাড়ের প্রভাব ও যৌক্তিকতা নিয়েও কাজ করবে এই টাস্কফোর্স, পাশাপাশি করছাড়ের বিষয়ে সুপারিশ থাকবে টাস্কফোর্সের প্রতিবেদনে। কমিটির সুপারিশ আমলে নিয়ে সময়েপযোগী উদ্যোগ গ্রহণ করা একান্ত প্রয়োজন। এনবিআরের সামগ্রিক কার্যক্রম স্বচ্ছ ও ব্যবসাবান্ধব হওয়া জরুরি। পাশাপাশি সুশাসন সর্বাগ্রে নিশ্চিত করতে হবে। স্বচ্ছ ও ব্যবসাবান্ধব এনবিআর গড়ে উঠুক; এটিই আমাদের প্রত্যাশা।