বাংলাদেশে বর্তমান প্রেক্ষাপটে প্রধানত ছয়টি ধারার শিক্ষা সমান্তরালে চলছে- ১. দরসে নিজামি/মাদ্রাসা (কওমী), ২. আলিয়া মাদ্রাসা, ৩. প্রচলিত সাধারণ স্কুল শিক্ষা, ৪. কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা, ৫. ইংরেজি মিডিয়াম/কমপ্লিট ইংরেজি কারিকুলাম, ৬. কারিগরি ও ভোকেশনাল শিক্ষা। প্রতিটি ধারার লক্ষ্য, পাঠ্যক্রম ও ভাষা ভিন্ন হওয়ায় নাগরিক ও জাতীয় জীবনে নানা ধরনের সমস্যা ও বৈষম্য তৈরি হচ্ছে। যেমন : সামাজিক বিভাজন ও মানসিক দূরত্ব; একই দেশের ছাত্ররা আলাদা ভাষা, সংস্কৃতি ও মূল্যবোধে বেড়ে ওঠে। ফলে পারস্পরিক বোঝাপড়া ও সহমর্মিতা কমে যায়। যার ফলে-
ইংরেজি মাধ্যম বা সাধারণ শিক্ষার শিক্ষার্থীরা সরকারি-বেসরকারি চাকরিতে অগ্রাধিকার পায়, কওমী বা আলিয়ার শিক্ষার্থীরা পিছিয়ে থাকে এবং চাকুিরর বাজারে বৈষম্য তৈরি হয়।
ভাষাগত বাধা : বাংলা, ইংরেজি ও আরবি- তিন ধারার ভাষা পার্থক্য নাগরিকদের মধ্যে যোগাযোগের দেয়াল তৈরি করে।
জাতীয় পর্যায়ে নীতি প্রণয়ন ও পরিকল্পনার জটিলতা : ভিন্নধর্মী কারিকুলাম রাষ্ট্রকে একক মানদণ্ড ঠিক করতে বাধাগ্রস্ত করে। ফলে আমরা কোেনা বৃহৎ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে জাতীয় ঐক্যে পৌঁছতে পারি না।
রাজনৈতিক মেরুকরণ : কয়েক ধারার শিক্ষাভিত্তিক শ্রেণি গড়ে ওঠে, যা রাজনীতিতে বিভাজনকে গভীর করে। এর ফলে সম্রারাজ্যবাদীরা সুবিধা নিয়ে ও আমাদেরকে ব্যবহার করে অষ্টেপৃষ্টে গিলে খাওয়ার সুযোগ তৈরি হয়।
অর্থনৈতিক ক্ষতি : দক্ষতা ঘাটতি ও কর্মবাজারে অমিলের কারণে দেশীয় শিল্প ও প্রযুক্তি খাতে মানবসম্পদের ঘাটতি বাড়ে/দেখা দেয়। সেক্ষেত্রে দক্ষলোক অন্যত্র থেকে নিয়ে আসতে হয়। ফলশ্রুতিতে আমাদের দেশ থেকে এক বিপুল অংশ অর্থ অনত্র চলে যায়।
একীভূত শিক্ষা ব্যবস্থার লক্ষ্য
সমতা ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গঠন। কর্মমুখী দক্ষতা নিশ্চিত করা। ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষার পাশাপাশি আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে পারদর্শিতা অর্জন। আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য যোগ্য নাগরিক তৈরি করা।
প্রস্তাবিত একীভূত শিক্ষা কাঠামো হওয়া উচিত
প্রাথমিক স্তর (১ম-৮ম শ্রেণি) একই জাতীয় কারিকুলাম, বাংলা হবে মূল ভাষা, ইংরেজি থাকবে বাধ্যতামূলক দ্বিতীয় ভাষা। নৈতিক/ধর্মীয় শিক্ষা হবে সব ধর্মের শিক্ষার্থীর জন্য নিজ নিজ ধর্মীয় মূল্যবোধ শেখার সুযোগ। বেসিক স্কিল হবে কম্পিউটার ও ডিজিটাল লিটারেসি, কৃষি ও হস্তশিল্পের প্রাথমিক ধারণা।
মাধ্যমিক স্তর (৯ম-১২শ) বিজ্ঞান, মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষা- তিন স্ট্রিমের পাশাপাশি কারিগরি ও ভোকেশনাল ট্র্যাক বাধ্যতামূলক বিকল্প। প্রত্যেক ছাত্রছাত্রীকে অন্তত একটি প্র্যাকটিক্যাল স্কিল (আইটি, কৃষি, শিল্পকলা, মেকানিক্স, স্বাস্থ্যসেবা ইত্যাদি) শেখাতে হবে।
উচ্চশিক্ষা হবে গবেষণা ও পেশাভিত্তিক শিক্ষা : বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা, প্রযুক্তি, উদ্যোক্তা ও উদ্ভাবনে জোর দিতে হবে। কওমী/আলিয়া ধারার ধর্মীয় উচ্চতর গবেষণা প্রোগ্রামকে জাতীয় কাঠামোর অধীনে এনে বৈশ্বিক মানদন্ডের বিচারে একাডেমিক স্বীকৃতি দেওয়া।
বাস্তবায়ন কৌশল
জাতীয় শিক্ষা কমিশন হবে : শিক্ষা বিশেষজ্ঞ, ধর্মীয় নেতা, শিল্পোদ্যোগী ও কারিগরি বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে একটি একীভূত শিক্ষা কমিশন। এই শিক্ষা কমিশন গঠন করে পুরো শিক্ষা নীতিকে ধাপে ধাপে রুপান্তর করা। যেমন :
প্রথম ৫ বছরে প্রাথমিক স্তরের সিলেবাস একীভূত করা। পরবর্তী ৫ বছরে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে রূপান্তর।
শিক্ষক প্রশিক্ষণ ও অবকাঠামো : নতুন কারিকুলাম অনুযায়ী শিক্ষক প্রশিক্ষণ, ডিজিটাল ক্লাসরুম, ল্যাব, ওয়ার্কশপ স্থাপন করা।
আইনগত সংস্কার : শিক্ষা আইন সংশোধন করে কওমী, আলিয়া, ইংরেজি মাধ্যমসহ সব প্রতিষ্ঠানের একটি জাতীয় মানদণ্ডে নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করা।
অর্থায়ন : জাতীয় বাজেটের কমপক্ষে ৬ শতাংশ শিক্ষা খাতে বরাদ্দ করতে হবে। সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বে কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপনে উৎসাহিত করা।
প্রত্যাশিত সুফল
সবাই একই মৌলিক দক্ষতা ও জ্ঞানে শিক্ষিত হবে এবং বৈষম্যহীন নগরিক গড়ে উঠবে। শিল্প, আইটি, কৃষি, স্বাস্থ্য- সব খাতে দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি হবে এবং কর্ম সংস্থান বৃদ্ধি পাবে। ধর্ম, ভাষা বা মাধ্যমভিত্তিক বিভাজন কমে যাবে ও সামাজিক ঐক্য গড়ে উঠবে। একীভূত কারিকুলাম বাংলাদেশকে বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় এগিয়ে নেবে। আন্তর্জাতিক ভাবে আমাদের সক্ষমতার জায়গা বৃদ্ধি পাবে।
উপসংহার
একটি জাতির শক্তি তার শিক্ষায়। বর্তমান বহুমুখী শিক্ষা ব্যবস্থা সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য সৃষ্টি করে জাতীয় উন্নয়নের গতি শ্লথ করছে। সময় এসেছে এক ও অভিন্ন, কর্মমুখী, বৈষম্যহীন শিক্ষা ব্যবস্থা বাস্তবায়নের। সরকারের সুদৃঢ় নীতি, সামাজিক ঐক্য, এবং ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক সহিষ্ণুতা দিয়েই এ স্বপ্ন বাস্তবে রূপ নিতে পারে।
লেখক : দপ্তর সম্পাদক, বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টি (বিএসপি), কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী পরিষদ