ঢাকা চেম্বারের সভাপতি ব্যারিস্টার মোঃ সামীর সাত্তার বলেছেন, হালকা প্রকৌশল শিল্পের বিকাশে সহায়ক নীতি সহায়তা প্রদান করা সম্ভব হলে আমাদের স্থানীয় খাদ্য, চামড়া ও পাদুকা, ইলেকট্রনিক্স, এগ্রো-প্রসেসিং এবং ঔষধ শিল্পের বেকওয়ার্ক লিংকেজ খাত হিসেবে স্থানীয় চাহিদা মেটাতে প্রয়োজনীয় পণ্য উৎপাদনে সক্ষম হবে, পাশাপাশি এখাত থেকে রপ্তানির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা আহরণ সম্ভব। তিনি বলেন, এখাতের টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিতকল্পে সরকার ‘শিল্পনীতি ২০২২’ তে খাতটিকে আগ্রাধিকার খাত হিসেবে চিহ্নিত করেছে, তবে এখন প্রয়োজন আর্থিক ও নীতি সহায়তা। ব্যারিস্টার সাত্তার বলেন, ২০২৫ সালে আমাদের জিডিপিতে বেসরকারিখাতের অবদান ২৭.৩৫% উন্নীতকরনের লক্ষ্যে এখাতে সার্বিক সহায়তা নিশ্চিতকরন একান্ত অপরিহার্য, যা শিল্পের স্থানীয় সাপ্লাইচেইন ব্যবস্থাকে আরো শক্তিশালী করবে। ডিসিসিআই সভাপতি উল্লেখ করেন, এখাতের কাঁচামাল আমদানিতে বর্তমানে বিদ্যমান শুল্ক নীতিমালা খাতটির বিকাশে তেমন উৎসাহব্যঞ্জক নয়, এমতাবস্থায় হালকা প্রকৌশল খাতের কাঙ্খিত বিকাশ নিশ্চিতকল্পে সহায়ক শুল্ক কাঠমো নিশ্চিতকরণ একান্ত আবশ্যক।
২৪ আগস্ট ২০২৩ বৃহস্পতিবার ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) আয়োজিত “বাংলাদেশের আমদানি বিকল্প শিল্প : প্রেক্ষিত হালকা-প্রকৌশল খাত” শীর্ষক সেমিনারে এসব কথা বলেন তিনি।
প্রধান অতিথি’র বক্তব্যে পরিকল্পনা মন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, হালকা প্রকৌশল খাতে দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান, মালয়েশিয়া, চীন ইতোমধ্যে উল্লেখযোগ্য সাফল্য দেখিয়েছে এবং বাংলাদেশেও সঠিক পথেই রয়েছে, প্রয়োজন যথাযথ নীতি সহায়তা এবং এর সঠিক বাস্তবায়ন। এ ব্যাপারের সরকারের পক্ষ হতে সকল সহযোগিতা প্রদান করা হবে এবং আশা প্রকাশ করেন দেশের বেসরকারিখাত বিদ্যমান চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় এখাতের কাঙ্খিত উন্নয়নে সফল হবে। তিনি বলেন, সরকারি পর্যায়ে নীতি সহায়তা নিয়ে সমন্বয়হীনতার কারণে শিল্পখাতের বিকাশ স্থিমিত হয়ে যায়, যেটি কোনভাবেই কাম্য নয়। মৌলিক মেশিনারীজ উৎপাদনে আমাদের সক্ষমতা আরো বৃদ্ধি বাড়াতে প্রয়োজনীয় সহায়তা নিশ্চিত করা আবশ্যক বলে মন্ত্রী মত প্রকাশ করেন। তিনি উল্লেখ করেন, ধোলাইখাল, জিঞ্জিরা সহ তৃণমূলের উৎদোক্তাদের উৎসাহ বৃদ্ধিতে আরো বেশি হারে নজর দিতে হবে।
বিশেষ অতিথি’র বক্তব্যে শিল্প মন্ত্রণালয়ের সচিব জাকিয়া সুলতানা বলেন, খাতটি এখনও আমদানি নির্ভর এবং আমাদের শিল্প খাতের বেকওয়ার্ড লিংকেজ শিল্পের জন্য এখাতটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, তাই এর প্রতি আরো বেশি হারে আমাদের মনোনিবেশ করতে হবে। সচিব আরো বলেন, ‘লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং ডেভেলপমেন্ট পলিসি ২০২২’-এ ২০২২-২৭ সালের জন্য একটি সমন্বিত কর্মপরিকল্পনার কথা বলা হয়েছে, যেটি এ খাতের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভমিকা পালন করবে। এখাতের উদ্যোক্তাদের আমদানি নির্ভরতা কমাতে উদ্যোক্তাদের আর্থিক প্রণোদনা ও নীতি সহায়তা প্রয়োজন এবং সরকারের সংশ্লিষ্ট সকল সেক্টরের অংশগ্রহণের মাধ্যমে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণে সরকার কাজ করছে। তিনি আরো বলেন, এখাতে দক্ষ মানব সম্পদ তৈরিতে আমাদের বিদ্যমান শিক্ষা কার্যক্রমের সংষ্কার ও যুগোপযোগীকরণের কোন বিকল্প নেই। শিল্প সচিব বলেন, অটোমোবাইল খাতের রিসার্চ ইন্সটিটিউট স্থাপনে ইতোমধ্যে জাপানের সাথে আলোচনা হয়েছে এবং আশা করেন এ ব্যাপারে প্রযুক্তি ও অবকাঠামো সহায়তা পাওয়া যাবে।
ওয়ালটন হাই-টেক ইন্ডাস্ট্রিজ-এর অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক এস এম শোয়েব হোসেন নোবেল সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। মূল প্রবন্ধে তিনি বলেন, বাংলাদেশের হালকা-প্রকৌশল খাত হতে বার্ষিক আয় বর্তমানে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা, জিডিপিতে যার অবদান ৩% এবং প্রতিবছর এখাতটি ১০% হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এখাতে প্রায় ১.৬ মিলিয়ন লোকের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হয়েছে এবং স্থানীয় চাহিদার প্রায় ৫০% আমরা উৎপাদন করতে সক্ষম হয়েছি বলে, তিনি জানান। শোয়েব আরো বলেন, ২০২১-২২ অর্থবছরে হালকা প্রকৌশল খাত হতে রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৭৯৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং এখাতের বৈশি^ক বাজারের পরিমাণ ৪৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এখাতের কাঁচামাল আমদানিতে শুল্ক সুবিধা প্রদান, বেকওয়ার্ড লিংকেজ শিল্পের উন্নয়নে নীতি সহায়তার পাশাপাশি আর্থিক প্রণোদনা একান্ত আবশ্যক প্রয়োজন বলে তিনি মত প্রকাশ করেন। এ শিল্পের সার্বিক বিকাশে একটি ‘গবেষণা উন্নয়ন ও ল্যাব’ স্থাপনে সরকারি ভাবে বিনিয়োগে এগিয়ে আসার আহবান জানান। ইলেকট্রিকাল ও ইলেকট্রনিক্স খাতের সহায়ক নীতি সহায়তা নিশ্চিত করা সম্ভব হলে আগামী বছরই ৩ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি সম্ভব তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
নির্ধারিত আলোচনায় বাংলাদেশ স্টিল ম্যানুফেকচার্স এসোসিয়েশন ও আনোয়ার গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ-এর চেয়ারম্যান মনোয়ার হোসেন বলেন, তৈরি পোষাক খাতের পাশাপাশি সম্ভাবনাময় অন্যান্য খাতের দিকের আমাদের মনোযোগী হতে হবে। তিনি আরো বলেন, আমাদের মানব সম্পদের সক্ষমতা বাড়াতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি, সরকারি-বেসরকারি খাতের সমন্বয় ও আর্থিক প্রণোদনা দেওয়ার আহŸান জানান। ফেয়ার গ্রæপের প্রধান মার্কেটিং কর্মকর্তা মোহাম্মদ মেছবাহ উদ্দিন বলেন, ২০৩০ সালে আমাদের স্থানীয় হালকা-প্রকৌশল শিল্পটি ১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের শিল্পে পরিণত হবে এবং এখাতের সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য শিক্ষাখাতের সংষ্কার, নীতি সহায়তা ও নীতির ধারাবাহিকতা একান্ত আবশ্যক, যা স্থানীয় ও বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষনে কার্যকর ভূমিকা পালন করবে। তবে প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ সহায়তার জন্য বিদেশি বিনিয়োগ এখাতে খুবই জরুরী বলে তিনি মত প্রকাশ করেন। মেঘনা গ্রæপের পরিচালক মোহাম্মদ মোস্তাক আহমেদ তানভীর বলেন, ইউরোপীয় বাজারে প্রতিবছর ৫ মিলিয়ন বাইসাইকেলের চাহিদা রয়েছে, যেখানে আমাদের উৎপাদিত বাইসাইকেল রপ্তানির প্রচুর সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। তিনি বলেন, বাইসাইকেলের রপ্তানির জন্য আমাদের টেস্টিং ল্যাব নেই, যার কারণে বিদেশের ল্যাবসমূহে উৎপাদিত পণ্যের টেস্টিং-এর প্রতিবেদন পেতে দীর্ঘ সময় লেগে যায়, এমতাবস্থায় দেশে আন্তর্জাতিক মানসম্মত একটি টেস্টিং ল্যাব স্থাপনে সরকারি বিনিয়োগ খুবই জরুরী বলে তিন মত প্রকাশ করেন। ট্রান্সকম ইলেকট্রনিক্স লিমিটেড-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আরশাদ হক বলেন, এ শিল্পের বিকাশে কমপক্ষে ১০ বছর মেয়াদী নীতি সহায়তা অব্যাহত রাখার পাশাপাশি বৈশি^ক সাপ্লাই চেইন ব্যবস্থায় নিজেদের সম্পৃক্তকরণ অতীব জরুরী। তিনি জানন, আমেরিকা ভিত্তিক হোয়ার্লপুল, ইতোমধ্যে যৌথভাবে বাংলপাদেশে বিনিয়োগ করেছে। তিনি আরো বলেন, আমাদের প্রচুর মানব সম্পদ রয়েছে, তবে তাদেরকে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ করে গড়ে তোলতে হবে। এখাতের প্রযুক্তিগত গবেষণার জন্য ল্যাব স্থাপনের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের প্রযুক্তিগত সহায়তার পাশাপাশি সরকারি পর্যায়ে বিনিয়োগে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।
মুক্ত আলোচনায় ঢাকা চেম্বারের প্রাক্তন সভাপতি মাতিউর রহমান বলেন, এখাতের আমদানি শুল্ক হ্রাস, দীর্ঘমেয়াদী নীতি সহায়তা, দক্ষতা উন্নয়ন এবং কারিগরি শিক্ষা সম্প্রসারণ করা প্রয়োজন।
ডিসিসিআই ঊর্ধ্বতন সহ-সভাপতি এস এম গোলাম ফারুক আলমগীর (আরমান) ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন।
ঢাকা চেম্বারের সহ-সভাপতি মোঃ জুনায়েদ ইবনে আলী, পরিচালনা পর্ষদের সদস্যবৃন্দ খাত হালকা-প্রকৌশল শিল্পের সাথে সম্পৃক্ত উদ্যেক্তাবৃন্দ সেমিনারে যোগদান করেন।