২৩ নভেম্বর ২০২৪, এখন সময় দুপুর ২:১৯ মিনিট
শিরোনাম
  1. অন্যান্য
  2. অর্থনীতি
  3. আইন-আদালত
  4. আন্তর্জাতিক
  5. কৃষি
  6. খুলনা
  7. খেলাধূলা
  8. গণমাধ্যম
  9. চট্রগ্রাম
  10. জাতীয়
  11. ঢাকা
  12. তথ্য-প্রযুক্তি
  13. ধর্মতত্ত্ব
  14. প্রকৃতি-পরিবেশ
  15. প্রবাস জীবন

কোটা আন্দোলন সহিংসতায় অর্থনীতির ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৭৭ হাজার কোটি টাকা

প্রতিবেদক
এ কে নাহিদ
জুলাই ২৬, ২০২৪ ১:৩৮ পূর্বাহ্ণ

কোটা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ব্যাপক সহিংসতা, ধ্বংসযজ্ঞ, ইন্টারনেট বন্ধ এবং নির্বাহী আদেশে সরকারি ছুটির কারণে দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড স্থবির হয়ে যায়। সমস্ত আমদানি-রপ্তানিসহ দেশীয় শিল্পের চাকা বন্ধ হয়ে যায়। এতে ব্যবসা-বাণিজ্যসহ মানুষের দৈনন্দিন চলাচলও বাধাগ্রস্ত হয়। এসব কারণে অর্থনীতিতে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ১০০ কোটি ডলার বা ১১ হাজার ৮০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে দেশের বিশেষজ্ঞমহল মনে করেন। গত ১৭ জুলাই থেকে ২৩ জুলাই পর্যন্ত টানা ৬ দিন প্রায় সবকিছুই বন্ধ ছিল। এই হিসাবে ক্ষতি হয়েছে ৬০০ কোটি ডলার বা ৭০ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। উল্লেখ্য, গত ১৬ জুলাই সন্ধ্যা থেকে ও ১৭ জুলাই আধাবেলা আন্দোলনের কারণে আংশিক বন্ধ ছিল। এই দুই দিনের আধাবেলার ক্ষতি প্রায় ৫০ কোটি ডলার বা ৫ হাজার ৯০০ কোটি টাকা। এই হিসাবে সাড়ে ৬ দিনে মোট ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় ৭৬ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। তবে অনেকের মতে, এই ক্ষতি ৭০০ কোটি ডলার বা ৮২ হাজার ৬০০ কোটি টাকাও হতে পারে।
টাইমওয়াচের অনুসন্ধান এবং দেশের শীর্ষস্থানীয় অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলাপ করে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। অনেক ব্যবসায়ী বলেছেন, ক্ষতির পরিমাণ আরো বেশি হবে। কারণ ডলারের দাম ১১৮ টাকা করে ধরলে ওই পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে। কিন্তু ডলার ১২২ থেকে ১৩০ টাকায় কিনতে হচ্ছে। এই কারণে ক্ষতির পরিমাণ টাকার অঙ্কে আরো বাড়বে বলে অনেকেই বলেছেন।
কোট আন্দোলনেকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট ক্ষতি মোকাবিলার জন্য ব্যবসায়ীগণ সব বন্দরের পণ্য খালাসে দেরি হওয়ায় ডেমারেজ চার্জ মওকুফ, নতুন চার্জ আরোপ না করা, ঋণের বিপরীতে বাড়তি সুদ আরোপ না করা, কম সুদে ঋণ দেওয়াসহ অন্যান্য নীতি সহায়তার দাবি করেছেন। একই সঙ্গে তারা রপ্তানি আয় বিদেশ থেকে আমদানি মেয়াদ বৃদ্ধি, দেশীয় ও বৈদেশিক ঋণের কিস্তি পরিশোধের মেয়াদ বাড়ানোর দাবি করেছেন।
চট্টগ্রাম বন্দরসূত্রে জানা গেছে, চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে মোট আমদানি-রপ্তানির প্রায় ৯৫ শতাংশ সম্পন্ন হয়। ফলে এই বন্দরের কার্যক্রম টানা পাঁচ দিন বন্ধ থাকায় ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এর মধ্যে আমদানি কার্যক্রম ও পণ্য ডেলিভারি বন্ধ থাকায় এই খাতে পাঁচ দিনে ক্ষতি হয়েছে কয়েক হাজার কোটি টাকা। এরমধ্যে কেবল চট্টগ্রাম কাস্টমসই ৯০০ কোটি টাকা রাজস্ব বঞ্চিত হয়েছে।
দেশের অনেক অর্থনীতিবিদদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, অর্থনীতির চাকা বন্ধ হলে ক্ষতি হতেই থাকে। এই চাকা এক মুহূর্তেই বন্ধ করা যায়। কিন্তু চালু করতে সময় লাগে। ফলে ক্ষতির পুরো হিসাব এখনই করা যাবে না। তবে ক্ষতির অঙ্ক অনেক বড় হবে। গবেষণায় গড় হিসাবে প্রতিদিন অর্থনৈতিক ক্ষতি প্রায় ১০০ কোটি ডলার হবে। টানা ছয় দিন বলতে গেলে সবকিছুই বন্ধ ছিল। সাড়ে ৬৫০ কোটি থেকে ৭০০ কোটি ডলারের ক্ষতি হতে পারে। তবে ক্ষতিটা সবচেয়ে বেশি হয়েছে সাধারণ মানুষের। বিশেষ করে যারা ‘দিন আনে দিন খায়।’ ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় ক্ষতির পরিমাণটা আরো বেড়েছে। এছাড়া দেশীয় উদ্যোক্তারাও অনেক ক্ষতির মুখে পড়েছেন। করোনার পর থেকে দেশের অর্থনীতি এমনিতেই বহুমুখী চ্যালেঞ্জের ভেতর দিয়ে এগোচ্ছে। বৈশ্বিক মন্দায় এই চ্যালেঞ্জ আরো বাড়িয়েছে। সাম্প্রতিক এই অস্থিরতায় অর্থনীতিতে চ্যালেঞ্জ আরো বাড়বে বলে অনেকেই আশঙ্কা করছেন। এই ধরনের পরিস্থিতিতে সবচেয়ে ক্ষতির মুখে পড়বে দেশের ইমেজ। দেশের উদ্যোক্তাদের সঙ্গে যেসব বিদেশি উদ্যোক্তা ব্যবসা করছেন তারা অনিশ্চয়তায় ভুগবেন। ফলে এই ধরনের সংকট যাতে না হয় সেদিকে সরকারকে তীক্ষ্ম নজর রাখতে হবে।
দেশের উদ্যোক্তারা জানান, সৃষ্ট অস্থিরতায় রপ্তানি খাতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে। একদিকে কারখানায় উৎপাদন বন্ধ ছিল। অন্যদিকে ক্রেতাদের আদেশ অনুযায়ী রপ্তানি করা সম্ভব হয়নি। এতে আগামীতে ক্ষতির পরিমাণ আরো বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন। এখন পর্যন্ত উৎপাদন ও রপ্তানি বাধাগ্রস্ত হওয়ায় গত ৬ দিনের হিসাবে ক্ষতির পরিমাণ ৮ হাজার কোটি টাকার বেশি। এছাড়া বিভিন্ন চার্জ ও ঋণের সুদ ও রপ্তানি পণ্য স্টক লট হলে কম দামে বিক্রি করতে হবে। তখন ক্ষতির পরিমাণ আরো বাড়বে বরে তারা মত প্রকাশ করেন।
দেশের রপ্তানিকারকগণ মনে করেন, রপ্তানির সব খাতেই ক্ষতি হয়েছে। এই ক্ষতির পরিমাণ আগামীতে আরো বাড়বে বরে তারা জানান। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় ক্ষতি হয়েছে- ‘ইমেজ সংকট’। ক্রেতা ধরে রাখাটা এখন বড় চ্যালেঞ্জিং। কারণ ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় ক্রেতাদের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। অনেক ক্ষেত্রে ক্রেতা ধরে রাখতে পণ্য এখন বিমানে পাঠাতে হবে। এতে খরচ বাড়বে। যা রপ্তানিকারকদের ক্ষতির তালিকায় পড়বে।
আমদানি কার্যক্রম ও পণ্য ডেলিভারি বন্ধ থাকায় এই খাতে পাঁচ দিনে বিপুল আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। টাকার অঙ্কে এই ক্ষতির পরিমাণ কত তা সুনির্দিষ্ট করে বলা না গেলেও ক্ষতির অঙ্ক কয়েক হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে বলে মনে করছেন আমদানিকারকসহ সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা। এর মধ্যে কেবল চট্টগ্রাম কাস্টমসই ৯০০ কোটি টাকা রাজস্ব বঞ্চিত হয়েছে।
জানা গেছে, চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৬৮ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আদায় করে। সে হিসাবে প্রতিদিন গড়ে ১৮০ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় হয়েছে। কোটা সংস্কার আন্দোলন, সংঘর্ষ ও রাষ্ট্রীয় স্থাপনায় দুর্বৃত্তদের হামলার জেরে ১৭ জুলাই রাত থেকে বন্ধ হয়ে যায় ইন্টারনেট পরিষেবা। ১৮ জুলাই রাত ১২টার পর থেকে জারি করা হয় কারফিউ। ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ হওয়ার কারণে কাস্টমসের রাজস্ব আদায়ের অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ড সিস্টেমও বন্ধ হয়ে যায়। তাই শুল্ক আদায়ও বন্ধ হয়ে যায়। বন্ধ হয়ে যায় পণ্য ডেলিভারি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ১৯ জুলাই থেকে ২৩ জুলাই পর্যন্ত শুল্কায়ন কার্যক্রম বন্ধ থাকায় প্রতিদিন গড়ে ১৮০ কোটি টাকা করে ৫ দিনে ৯০০ কোটি টাকার রাজস্ব বঞ্চিত হয় সরকার। প্রতিদিন আমদানি পণ্য ছাড়ের জন্য ৪-৫ হাজার বিল অব এন্ট্রি (বিই) দাখিল হতো। ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ থাকার কারণে এসব পণ্যের বিএই দাখিল করা যায়নি। এছাড়া প্রতিদিন চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ৮-১০ হাজার ট্রাক-কাভার্ডভ্যান, লরি পণ্য নিয়ে বের হয়। এই পাঁচ দিন কোনো পণ্য ডেলিভারি হয়নি। শিল্পের কাঁচামাল না পাওয়ায় শত শত মিল-কারখানায় বন্ধ ছিল উৎপাদন। স্টিল সেক্টর, সিমেন্ট সেক্টরসহ প্রায় সব সেক্টরেই পড়েছে এই প্রভাব। এছাড়া বন্দর থেকে সময়মতো পণ্য ছাড় করতে না পারায় আমদানিকারকদের ওপর উঠেছে পোর্ট ও শিপিং লাইনের বিপুল অঙ্কের ডেমারেজ। বন্দরে স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে অতিরিক্ত ৬-৭ হাজার কনটেইনার জমে যায়। পাঁচ দিন সব কিছু বন্ধ থাকার কারণে কেবল আমদানি খাতেই কয়েক হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। তবে সুনির্দিষ্ট করে টাকার অঙ্কে এই ক্ষতি নিরূপণ করা সম্ভব নয়। তবে বন্দর-কাস্টমসহ সব সেক্টরে প্রতিদিন গড়ে ১২ হাজার থেকে ১৩ হাজার কোটি টাকার ব্যবসায়িক ক্ষতি হয়েছে বলে তারা ধারণা করছেন।
চট্টগ্রাম বন্দর ও কাস্টমস এখন পুরোদমে কাজ শুরু করেছে। উদ্ভুত পরিস্থিতির কারণে ব্যবসা-বাণিজ্যের যে ক্ষতি হয়েছে তা কাটিয়ে উঠতে করণীয় নির্ধারণে চট্টগ্রাম চেম্বার ২৫ জুলাই সব সেক্টরের প্রতিনিধি এবং প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। বৈঠক থেকে বলা হয়েছে, বড় ধরনের বিপদ থেকে দেশ ঘুরে দাঁড়িয়েছে। আর একটি সেকেন্ডও যাতে ওয়েস্টেজ না হয় সেভাবে সবাইকে কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহবান জানানো হয়। এক্ষেত্রে সরকার ও প্রশাসনের পক্ষ থেকে ব্যবসায়ীদের সব ধরনের সহায়তা দেওয়ার আশ্বাস দেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ ফ্রেইট ফরওয়ার্ডারস অ্যাসোসিয়শনের সহসভাপতি ও শিপিং এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশন সূত্রে জানা গেছে, পণ্য নিয়ে অনেক জাহাজ এলেও চার দিনে খালাস করা সম্ভব হয়নি। পণ্য ডেলিভারি না হওয়ায় চট্টগ্রাম বন্দরে জমে যায় বাড়তি ৬-৭ হাজার কনটেইনার। পণ্য না পেয়ে মিল-কারখানায় উৎপাদন ব্যহত হয়েছে। যার ভয়াবহ প্রভাব ভোক্তাদের ওপর পড়েছে। উদ্যোক্তারা জানান, ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় সফটওয়্যার রপ্তানি বাধাগ্রস্ত হয়েছে। অফিস বন্ধ থাকায় সফটওয়্যার তৈরির কাজও করা সম্ভব হয়নি। এসব কারণে গত ৫ দিনে এ খাতে ক্ষতি হয়েছে প্রায় ৫০০ কোটি টাকা। দেশ থেকে যারা সফটওয়্যার বা তথ্যপ্রযুক্তি পণ্য কিনেছেন তাদের রপ্তানিকারকরা বিভিন্ন সেবা দিয়ে থাকেন অনলাইনে। কিন্তু ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় এই সেবা দেওয়া সম্ভব হয়নি। ফলে সেবা বাবদ অর্থও মিলবে না। এই প্রসঙ্গে বাংলাদেশ সফটওয়্যার ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (বেসিস) সভাপতি রাসেল টি আহমেদ বলেন, ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় ক্রেতাদের সেবা দেওয়া সম্ভব হয়নি। এ ধরনের পরিস্থিতির কারণে ক্রেতারা সেবা না পাওয়ায় তাদেরও ক্ষতি হয়েছে। এতে দেশের ইমেজ নষ্ট হয়েছে। ফলে ভবিষ্যতে দেশ থেকে তথ্যপ্রযুক্তি পণ্য রপ্তানিতে জটিলতা দেখা দিতে পারে। কারণ এসব পণ্য রপ্তানির পর পরিচালনার ক্ষেত্রে সমস্যা হলে সেবা দিতে হয়।
জানা গেছে, ওষুধ উৎপাদন, রপ্তানি ব্যাহত, কাঁচামাল ছাড় করাতে না পারায় ফার্মাসিউটিক্যালস খাতে ক্ষতি হয়েছে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা। এ খাতে যেসব কাঁচামাল বন্দরে আটকে ছিল সেগুলোর গুণগত মান কমার আশঙ্কা রয়েছে। কারণ এই খাতের সবকিছুই চলে ঘণ্টা গুণে।
রপ্তানি বাধাগ্রস্ত হওয়ায় সিরামিক খাতে ক্ষতি হয়েছে প্রায় ৫০০ কোটি টাকা। রি-রোলিং মিলস খাতে শুধু উৎপাদন ক্ষতি হয়েছে হাজার কোটি টাকার বেশি। ই-কমার্স খাতে ক্ষতি হয়েছে প্রায় ৩০০ কোটি টাকা। ইন্টারনেট না থাকায় দেশের কলসেন্টারগুলোর কার্যক্রম একেবারেই মুখ থুবড়ে পড়েছে। ৫ দিনে এ খাতে ক্ষতি হয়েছে প্রায় ২০০ কোটি টাকা।
গণপরিবহণ না চলার কারণে এই খাতেও অনেক ক্ষতি হয়েছে। অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুরের কারণে ক্ষতি হয়েছে প্রায় ২২ কোটি টাকা। দেশের কৃষির উৎপাদন ব্যবস্থায় তেমন ক্ষতি হয়নি। তবে বিপণন ব্যবস্থায় ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। কারফিউর কারণে পণ্য পরিবহণ বাধাগ্রস্ত হয়েছে। ফলে কৃষকের কৃষি পণ্য পচে নষ্ট হয়েছে। দেশের দুগ্ধ শিল্পের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। খামারী দুধ বিক্রি করতে না পেরে ফেলে দিয়েছে।

সর্বশেষ - আইন-আদালত