১১ আগস্ট ২০২৫, এখন সময় দুপুর ১:৪২ মিনিট
শিরোনাম
  1. অন্যান্য
  2. অর্থনীতি
  3. আইন-আদালত
  4. আন্তর্জাতিক
  5. কৃষি
  6. খুলনা
  7. খেলাধূলা
  8. গণমাধ্যম
  9. চট্রগ্রাম
  10. জাতীয়
  11. ঢাকা
  12. তথ্য-প্রযুক্তি
  13. ধর্মতত্ত্ব
  14. প্রকৃতি-পরিবেশ
  15. প্রবাস জীবন

মাইলস্টোন ট্র্যাজেডি : আগুনে পুড়ছে আগামীর প্রজন্ম

প্রতিবেদক
A K Nahid
জুলাই ২৮, ২০২৫ ৫:১৪ অপরাহ্ণ

২১ জুলাই, বেলা সোয়া ১টা। ক্লাস ছুটির পর বাড়ি ফেরার অপেক্ষা কোমলমতি খুদে শিক্ষার্থীদের। বাইরে ছিলেন অভিভাবকরা । আবার কোনো কোনো শিক্ষার্থী প্রস্তুতি নিচ্ছিল কোচিংয়ে বসার। অন্যান্য দিনের মতোই কোলাহলপূর্ণ ছিল রাজধানীর উত্তরার দিয়াবাড়িতে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ প্রাঙ্গণ। হঠাৎ প্রতিষ্ঠানটির একাডেমিক ভবনে আকাশ থেকে আছড়ে পড়ে বিমানবাহিনীর একটি যুদ্ধবিমান। বিদ্যুৎগতিতে ঢুকে পড়ে জুনিয়র শিক্ষার্থীদের ক্লাসভবনে। বিস্ফোরিত হলো বিমানটি। প্রচÐ শব্দে কেঁপে উঠল পুরো এলাকা। কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগে মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ে আগুনের লেলিহান শিখা। ওই আগুনে জলসে গেছে বিপুলসংখ্যক কোমলমতি শিক্ষার্থীর দেহ। পুড়ে অঙ্গার হয়েছে কেউ কেউ। ভবনের ভেতরে পড়েছিল অনেকের ছিন্নবিচ্ছিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ। এরপর হতাহতদের নিয়ে ছুটেছে সবাই রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে। এ খবর নিমেষেই ছড়িয়ে পড়ল সারা দেশসহ পুরো বিশ্বে। চোখের পানি ধরে রাখতে পারেননি কেউ। শুধু অভিভাবক ও শিশুদের স্বজন নয়, কান্নার রোল পড়ে ঘরে ঘরে। স্কুল প্রাঙ্গণ ও হাসপাতালগুলোতে হতাহতের স্বজনের আহাজারিতে ভারী হয়ে ওঠে আকাশ-বাতাস। শোকে স্তব্ধ হয়ে পড়ে গোটা দেশ। এ ঘটনায় রাষ্ট্রপতি, প্রধান উপদেষ্টা, উপদেষ্টাগণ, প্রধান বিচারপতি শোক জানিয়েছেন। পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতারা শোক জানিয়েছেন। এছাড়া বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধান ও সরকারপ্রধানসহ জাতিসংঘ গভীর শোক প্রকাশ করেছে। আর রাষ্ট্রীয়ভাবে ২২ জুলাই শোক পালন করেছে অন্তর্বর্তী সরকার।
আইএসপিআর জানিয়েছে, নিহতদের মধ্যে ঢাকা সিএমএইচে ১২ জন, বার্ন ইনস্টিটিউটে দুজন, কুর্মিটোলা জেনারেল হসপিটালে দুজন, উত্তরার লুবনা জেনারেল হাসপাতাল অ্যান্ড কার্ডিয়াক সেন্টারে দুজন, ঢাকা মেডিকেলে এক, উত্তরা আধুনিক হসপিটালে একজনের লাশ আছে। তাৎক্ষণিকভাবে নিহতদের সবার পরিচয় জানা যায়নি। তবে শনাক্ত হওয়ায় রাতেই আটটি লাশ অভিভাবকদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। তারা হলো- ফাতেমা আক্তার (৯), সামিউল করিম (৯), রজনী ইসলাম (৩৭), মেহনাজ আফরিন হুরাইরা (৯), শারিয়া আক্তার (১৩), নুসরাত জাহান আনিকা (১০), সাদ সালাউদ্দিন (৯) এবং সায়মা আক্তার (৯)। এদিকে ২১ জুলাই রাত ১০টা ১০ মিনিটে বার্ন ইউনিটের আইসিইউতে মৃত্যুবরণ করেন মাইলস্টোন স্কুলের কো-অডিনেটর মেহেরীন চৌধুরী। স্কুলটির একাধিক শিক্ষক জানান, দুর্ঘটনার পর মেহেরীন চৌধুরীর শরীরে দ্রæত আগুন ছড়িয়ে পড়ে। ওই সময় নিজের জীবন বাজি রেখে তার আদরের শিক্ষার্থীদের বাঁচাতে মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন। শরীরের দগ্ধ আগুন নিয়েই তিনি শিক্ষার্থীদের বাঁচাতে লাগলেন। এক এক করে অনেক শিশুকে রুম থেকে বেরও করেন। এক পর্যায়ে তিনি লুটিয়ে পড়েন। তাকে যখন বার্ন ইউনিটে আনা হয় তখন তার শরীর শতভাগ পোড়া ছিল। জরুরি বিভাগ থেকে দ্রæত আইসিইউতে ভর্তি করা হয় তাকে। ওখানে তাকে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়। এছাড়া ২১ জুলাই রাত ১০টা ১৭ মিনিটের দিকে শামীম আব্দুল্লাহ নামে ১৪ বছরের আরেক শিক্ষার্থীর মৃতু হয় আইসিইউতে। তাকেও লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়েছিল। তার শরীর ৯০ শতাংশ পোড়া ছিল। তার বড় ভাই জাহিদ আইসিইউর সামনে বিলাপ করছিল। পাশেই মা, আর বোন আর্তনাত করতে করতে বারবার জ্ঞান হারাচ্ছিল। বুক থাপড়িয়ে মা জুলেখা বেগম বলছিলেন, তার ছেলে তার শরীর টিপে দিয়েছিল। মাকে বলছিল, মায়ের সেবা করে জান্নাতে যেতে চায়। মায়ের সঙ্গে সবসময় থাকতে চায়। মাকে কখনো হারাতে চায় না। এমনটা বলতে বলতে মা মাটিতে লুটিতে পড়ছিলেন। বলছিলেন, ছেলেকে কবর দেবেন না, বুকে জড়িয়ে ধরে শুইয়ে থাকবেন। আইএসপিআর আরো জানায়, এফটি-সেভেন বিজিআই যুদ্ধবিমানটি নিয়মিত প্রশিক্ষণের অংশ হিসাবে ২১ জুলাই বেলা ১টা ৬ মিনিটে কুর্মিটোলাস্থ বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর ঘাঁটি থেকে উড্ডয়নের কিছু সময় পর বিধ্বস্ত হয়। দুর্ঘটনা মোকাবিলায় এবং বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে ওই বিমানের বৈমানিক ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মো. তৌকির ইসলাম বিমানটিকে ঘনবসতি এলাকা থেকে জনবিরল এলাকায় নিয়ে যাওয়ার সর্বাত্মক চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত বিমানটি ঢাকার দিয়াবাড়িতে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের দোতলা একটি ভবনে অনাকাঙ্খিত দুর্ঘটনায় বিধ্বস্ত হয়েছে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বিমান বিধ্বস্তের খবর ছড়িয়ে পড়ার মুহূর্তেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছুটে আসেন শত শত অভিভাবক, আশপাশের মানুষ ও উদ্ধারকর্মীরা। যে প্রতিষ্ঠানটি শিক্ষার্থীদের কোলাহলে কিছুটা সময় আগেও মুখরিত ছিল, মুহূর্তেই সেখানে নেমে আসে ভয়, আতঙ্ক ও শোকময় পরিবেশ। শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের গগনবিদারী চিৎকারে পুরো পরিবেশ ভারী হয়ে ওঠে। সন্তানের খোঁজে পাগলের মতো এদিক-ওদিক ছুটতে থাকেন অভিভাবকরা। আকস্মিক এমন ঘটনায় দিশেহারা হয়ে পড়েন শিক্ষক ও কলেজ কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও। ঘটনার পরপরই উদ্ধার অভিযান শুরু করে সেনাবাহিনী, বিজিবি, ফায়ার সার্ভিস, র‌্যাবসহ বিভিন্ন বাহিনীর সদস্যরা। মাইলস্টোন কলেজ থেকে বের হয়ে আসতে থাকে আহতদের মিছিল। তাদের নিয়ে একের পর এক অ্যাম্বুলেন্স ছুটে চলে সাইরেন বাজিয়ে, সেগুলোকে পাহারা দিয়ে এগিয়ে নিয়ে যায় সামরিক যান। বাঁশি বাজিয়ে ভিড় সামাল দেওয়ার চেষ্টা করেন সেনাবাহিনীর সদস্য ও শিক্ষার্থীরাও। সামরিক হেলিকপ্টার দিয়েও আহতদের উদ্ধার করতে দেখা গেছে।
শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা জানান, ভবনে বিমান বিধ্বস্ত হওয়ায় সেখানে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। ওই আগুনে অনেকেই ভস্মীভূত হয়ে গেছেন। এমনকি অনেকের চেহারাও চেনা যায়নি। কুর্মিটোলা হাসপাতালের একজন চিকিৎসক জানান, ২১ জুলাই বিকাল ৫টা পর্যন্ত ওই হাসপাতালে তিনজনকে আনা হয়। তাদের মধ্যে দুজনের শরীর এতটাই পুড়ে গেছে যে, তাদের লাশ শনাক্ত করার কোনো উপায় নেই। আরেকজন মুসতাইন মুনামকে (১৩) আহত অবস্থায় এ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তাকে অবজারভেশনে রাখা হয়েছে। ওই চিকিৎসক আরো জানান, বিভিন্ন হাসপাতালে রক্তের সংকট শুনে রাজধানীর বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অনেক শিক্ষার্থী এ হাসপাতালে আহতদের স্বেচ্ছায় রক্ত দেওয়ার জন্য এসেছেন। কিন্তু রোগীর চাপ না থাকায় তাদের থেকে রক্ত নেওয়া হয়নি। আইএসপিআর আরো জানিয়েছে, আহত সবাইকে বিমানবাহিনীর হেলিকপ্টারসহ অ্যাম্বুলেন্সের সহায়তায় সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল (সিএমএইচ) এবং নিকটস্থ হাসপাতালে প্রয়োজনীয় চিকিৎসার জন্য দ্রæত স্থানান্তর করা হয়। আহতদের মধ্যে কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে ৮ জন, বার্ন ইনস্টিটিউটের ৭০ জন, ঢাকা সিএমএইচে ১৪ জন, উত্তরার লুবনা জেনারেল হাসপাতাল ও কার্ডিয়াক সেন্টারে ১১ জন, উত্তরা আধুনিক হসপিটালে ৬০ জন এবং উত্তরা ক্রিসেন্ট হাসপাতালে একজন চিকিৎসাধীন রয়েছেন বলে জানানো হয়। ঘটনা তদন্তে কমিটি গঠন করা হয়েছে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, মাইলস্টোন স্কুলের যে ভবনের সামনে বিমানটি বিধ্বস্ত হয়, সেটি দোতলা। ওই ভবনে দুটি তলা মিলিয়ে ১৬টি ক্লাসরুম আছে। আর ৪টি শিক্ষকদের রুম। প্রাথমিকের প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণির ক্লাস হতো এই ভবনে। তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির শ্রেণিকক্ষের সামনে বিমানটি বিধ্বস্ত হয়েছে। শিক্ষার্থীরা আরো জানিয়েছে, ছুটির পর ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থীরাও ছিল ওই ভবনে। মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী সায়েম জানান, ১টার কিছু পর ক্লাসে থাকাবস্থায় বিকট শব্দ পান। তখন তিনি পাশের চার নম্বর ভবনের শ্রেণিকক্ষে ছিলেন। দৌড়ে এসে দেখেন আগুন জ্বলছে হায়দার আলী ভবনে। তারা (শিক্ষার্থী) ফায়ার এক্সটিংগুইশার নিয়ে আগুন নেভানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু আগুনের এত তীব্রতা ছিল যে তারা কাছে যেতে পারেননি। কিছু শিক্ষার্থী আগুন গায়ে নিয়ে বের হয়ে আসে। কিছু শিক্ষার্থী ক্লাসরুমে আটকা পড়ে। প্রধান ফটকের ভেতর বিমানটি ঢুকে যাওয়ায় সেখান দিয়ে শিক্ষার্থীরা বের হতে পারেনি। কারণ, চারপাশ লোহার গ্রিল দিয়ে আটকানো ছিল। প্রত্যক্ষদর্শী অনেক শিক্ষার্থী বলেন, ভবনটিতে ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণির ক্লাস নেওয়া হয়। স্কুল ১টার মধ্যে ছুটি হয়ে যায়। ছুটি হয়েও ছিল, কিছু শিক্ষার্থী বের হয়েছিল, কিছু বের হওয়ার অপেক্ষায় ছিল। অনেকে আবার স্যারদের কাছে কোচিংয়ের জন্য অপেক্ষা করছিল। তখনই বিমানটি বিধ্বস্ত হয়। বিমানটি প্রধান ফটকের গেট ভেঙে এসে কক্ষের ভেতরে ঢুকে যায়। সেখানে আগুন ছড়িয়ে পড়লে তাতে আক্রান্ত হয় কোমলমতি শিক্ষার্থীরা। তারা আরো জানান, আগুনের তীব্রতা পুরো ভবনটি কালচে হয়ে গেছে। ভবনের সামনে গাছ পুড়েছে। উদ্ধারকাজে অংশ নেওয়া কয়েকজন সেনাসদস্য আহত হয়েছেন।
দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী সাদমান তানভীর বলেন, আমরা যখন ক্লাসে ছিলাম, তখন বিস্ফোরণের মতো একটা শব্দ হয়েছে। আমরা কেউ বুঝতে পারিনি প্রথমে। তারপর হঠাৎ যখন সবাই দৌড়াদৌড়ি, ছোটাছুটি করল, তারপর স্যার এলেন। দেখি ১ নম্বর বিল্ডিংয়ে বিমানের কিছু অংশ বøাস্ট হইছে। যে কারণে পুরো বিল্ডিংয়ে আগুন ধরে গেছে। তারপর আমরা বের হয়েছি। তারপর দেখি ফায়ার সার্ভিস। তিনি বলেন, পাশেই ফায়ার সার্ভিস আর পাশেই আর্মি ক্যাম্পও ছিল। যে কারণে সবাই দ্রæত চলে আসছে। আগুন নেভাতে বেশি সময় লাগেনি; কিন্তু ভেতরে অনেক মানুষ ছিল। ছোট বাচ্চারা ছিল। ওদের বের করতে অনেক সময় লাগে। মাইলস্টোনের দুর্ঘটনাকবলিত এলাকা পরিদর্শনের সময় বিকাল পৌনে ৫টার দিকে ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ জাহেদ কামাল বলেন, বিমানবাহিনীর একটি ফাইটার এয়ারক্র্যাফট বেলা ১টার দিকে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের উত্তরা শাখার দোতলা স্কুল ভবনে ক্যাশ ল্যান্ডিং করেছে। এই দোতলা ভবনের প্রথম তলায় ছিল তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির বাচ্চাদের ক্লাস। দ্বিতীয় তলায় ছিল দ্বিতীয় ও পঞ্চম শ্রেণির ক্লাস। তার সঙ্গে ছিল প্রিন্সিপালের (অধ্যক্ষের) অফিস মিটিং রুম। একটা কোচিংয়ের ক্লাস চলমান ছিল। ক্র্যাশ ল্যান্ডিং যখন হয়, তখন স্কুল ছুটি হয়ে গিয়েছিল এবং ওই সময় যে জায়গায় টিচার্স রুমের সঙ্গে যে ল্যান্ডিং হয়, আঘাত করে, ওই জায়গায় বাচ্চারা জড়ো হয়েছিল এবং তাদের সঙ্গে হয়তো কিছু অভিভাবকও ছিল। তিনি জানান, ফায়ার সার্ভিসের ৯টি ইউনিট উদ্ধারকাজ চালায়। বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় আহতদের দ্রæত চিকিৎসায় ব্যবহার করা হয় হেলিকপ্টার ও মেট্রোরেল। মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের পাশেই মেট্রোরেলের স্টেশন। ঘটনার পরপরই মেট্রোরেলের নারীদের কামরার পাশের কামরাটি হতাহতদের জন্য রিজার্ভ ঘোষণা করে পুলিশ। সরেজমিন দেখা যায়, দুপুর ২টা ৪৮ মিনিটে বিমানবাহিনীর একটি উদ্ধারকারী হেলিকপ্টার মাইলস্টোন মাঠের খালি জায়গায় অবতরণ করে। এ সময় স্ট্রেচারে করে একজনকে হেলিকপ্টারে উঠিয়ে দিতে দেখা গেছে। ৩টা ২০ মিনিটে অপর একটি হেলিকপ্টার দিয়ে ঘটনাস্থল থেকে আরো একজনকে উদ্ধার করা হয়েছে। তবে উদ্ধারকৃতদের নাম-পরিচয় নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে এই ঘটনায় নিহত ও হতাহতের সংখ্যা নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে। বিভিন্ন মহল ও জনমনে নানান প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে। এ নিয়ে সরব সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোও। অনেকেই যার যার মতো করে অভিমত ব্যক্ত করছেন। মৃত্যু নিয়ে এখন পর্যন্ত কেউ বলছেন মারা গেছেন ২৯ জন, কেউ বলছেন ৩০, আবার কেউবা বলছেন ৩১ জন। এছাড়া মর্মান্তিক এ দুর্ঘটনায় অগ্নিদগ্ধ হয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন মোট আহতের সংখ্যা নিয়েও পাওয়া যাচ্ছে ভিন্ন ভিন্ন তথ্য। এ অবস্থায় বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় হতাহতের সংখ্যা নিয়ে সর্বশেষ তথ্য তুলে ধরেছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হাসপাতাল ও ক্লিনিক শাখার পরিচালক ডা. আবু হোসেন মো. মঈনুল হোসেন। তার সই করা এক পরিসংখ্যানের তথ্যের (টেলিফোনের মাধ্যমে প্রাপ্ত) বরাতে ২৩ জুলাই দুপুরে প্রধান উপদেষ্টার জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিব ফয়েজ আহম্মদ জাগো নিউজকে এ তথ্য জানান। তিনি জানিয়েছেন, বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় ২৩ জুলাই দুপুর পৌনে ১টা পর্যন্ত অগ্নিদগ্ধ হয়ে মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৯ জনে। এছাড়া জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটসহ বিভিন্ন হাসপাতালে অগ্নিদগ্ধ হয়ে চিকিৎসাধীন ৬৯ জন। পরিসংখ্যান বলছে, নিহত ২৯ জনের মধ্যে জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটে ১১ জন, সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) ১৫ জন, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে একজন, লুবানা জেনারেল হাসপাতাল অ্যান্ড কার্ডিয়াক সেন্টারে একজন (পরিচয় জানা যায়নি) ও ইউনাইটেড হাসপাতালে একজন মারা গেছেন।
তথ্য অনুযায়ী, অগ্নিদগ্ধদের মধ্যে বর্তমানে জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটে ৪৪ জন, সিএমএইচে ২১ জন, কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে একজন, শহীদ মনসুর আলী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে একজন, উত্তরা আধুনিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে একজন ও হিউম্যান এইড রিসার্চ ল্যাব অ্যান্ড হাসপাতালে একজন চিকিৎসাধীন আছেন। ২৯ জনের মধ্যে জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটে ১১ জন, সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) ১৫ জন, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে একজন, লুবানা জেনারেল হাসপাতাল অ্যান্ড কার্ডিয়াক সেন্টারে একজন (পরিচয় জানা যায়নি) ও ইউনাইটেড হাসপাতালে একজন মারা গেছেন। ডা. আবু হোসেনের পরিসংখ্যান মোতাবেক, জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটে মারা যাওয়া ১১ জন হলেন- তানভীর (১৪), আদনান ফাইয়াজ (১৪), মাহেরীন (৪৬), বাপ্পি (৯), মাসুকা (৩৭), এবি শামীম (১৪), শায়ান ইউসুফ (১৪), এরিকসন (১৩), আরিয়ান (১৩), নাজিয়া (১৩) ও নাফি (৯)। সিএমএইচে মারা যাওয়া ১৫ জন হলেন- রজনী ইসলাম (৩৭), এমডি সামিউল করিম (৯), ফাতেমা আক্তার (৯), মেহেনাজ আফরিন হুমায়রা (৯), সারিয়া আক্তার (১৩), নুসরাত জাহান আনিকা (১০), সাদ সালাউদ্দিন (৯) ও সায়মা আক্তার (৯)। তাদের মরদেহ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এছাড়া বিধ্বস্ত বিমানটির পাইলট ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট তৌকির ইসলামের মরদেহ এরই মধ্যে সমাহিত করা হয়েছে। ওই হাসপাতালে মারা যাওয়া অজ্ঞাতপরিচয় আরও ৬ জন রয়েছেন। এ ছয়জনের মরদেহ মর্গে রাখা হয়েছে। একই সূত্রে পাওয়া তথ্য বলছে, ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গ থেকে ৯ বছরের শিশু জুনায়েতের মরদেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। লুবানা জেনারেল হাসপাতালে অজ্ঞাতপরিচয় (বয়স উল্লেখ নেই) একজনের মরদেহ রয়েছে। গুলশানের ইউনাইটেড হাসপাতাল থেকে উমায়ের নূর আসফিক নামে ১১ বছর বয়সী এক শিশুর মরদেহ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ৬৯ জনের মধ্যে পাঁচজন শিক্ষক, ৪১ জন শিক্ষার্থী, একজন স্কুল স্টাফ, একজন ফায়ার ফাইটার, একজন পুলিশ, ১৪ জন সেনাসদস্য, একজন আয়া, একজন ইলেকট্রিশিয়ান ও অন্যান্য চারজন রয়েছেন।
জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটে বর্তমানে চিকিৎসাধীন ৪৪ জনের মধ্যে ৩৫ জন শিক্ষার্থী, চারজন শিক্ষক, একজন ইলেকট্রিশিয়ান ও একজন আয়া রয়েছেন। অপর তিনজনের পরিচয় জানা যায়নি। আহতদের মধ্যে জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটে বর্তমানে আটজন ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন রয়েছেন। তারা হলেন- মাহাতাব (১৪), মাসুমা (৩২), আইয়ান (১৪), মাহিয়া (১৫), জারিফ (১২), শিক্ষিকা মাহফুজা খাতুন (৪৫), নাবিদ নাওয়াজ (১২) ও সাইমন (১৮)। সেখানে পোস্ট অপারেটিভ ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন ২১ জন হলেন- তাসনুবা মাহবিন (১১), ফারজানা ইয়াসমিন (৪৫), তাসনিয়া (১০), শ্রেয়া (৯), রাইসা (১১), পায়েল (১২), শিক্ষিকা নিশি (২৮), নুসরাত (১২), তৌফিক (১৩), ইউসা (১১), জাকির (৫৫), সায়েবা (৯), আলবিনা (১০), মুনতাহা (১০), রুপি বড়ুয়া (১০), জায়ানা (১৩), নিলয় (১৩), শিক্ষক আশরাফুল ইসলাম (৩৭), শিক্ষিকা সুমাইয়া লরিন (৩০), লরিন কাব্য (১৩) ও কাফী আহমেদ (১০)। এছাড়া আহত পুরুষদের মধ্যে হাই ডিপেন্ডেন্সি ইউনিটে (এইচডিইউ) চিকিৎসাধীন আছেন মাকিন (১৫), আরিয়ান আফিফ (১২), রোহান (১৪), রাইয়ান (১৪) ও আবিদুর রহমান (১০)। আহত নারীদের মধ্যে এইচডিইউ চিকিৎসাধীন আছেন সামিয়া (৯), সাইবা জাহান (১০), তাসনিয়া (১৫), মেহেরিন (১১), আইমান (১০), সায়রা (১০), সবুজা বেগম (৪০) ও হাফসা খান (১১)। আয়ান খান (১২) ও কাজী আমজাদ সাঈদ (২০) নামে দুজন জরুরি বিভাগে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। চিকিৎসাধীন ৬৯ জনের মধ্যে পাঁচজন শিক্ষক, ৪১ জন শিক্ষার্থী, একজন স্কুল স্টাফ, একজন ফায়ার ফাইটার, একজন পুলিশ, ১৪ জন সেনাসদস্য, একজন আয়া, একজন ইলেকট্রিশিয়ান ও অন্যান্য চারজন রয়েছেন
সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ২৮ জনের মধ্যে পাঁচজনকে হাসপাতাল থেকে রিলিজ দেওয়া হয়েছে। দুজনকে জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটে স্থানান্তর করা হয়েছে। বর্তমানে ২১ জন চিকিৎসাধীন আছেন। তাদের মধ্যে শিক্ষার্থী ৩ জন, শিক্ষক ১ জন, স্কুল স্টাফ ১ জন, ফায়ার সার্ভিস কর্মী ১ জন, পুলিশ ১ জন ও সেনাসদস্য ১৪ জন। সিএমএইচে বার্ন আইসিইউতে আছেন চারজন। তারা হলেন- আকিব (১২), আনোয়ার (৩৪), আতিক (২১) ও বিল্লাল হোসেন (১২)। এছাড়াও অগ্নিদগ্ধদের মধ্যে বর্তমানে চিকিৎসাধীন রয়েছেন- আহসান (৪৫), হাবিবুল্লাহ (২৪), আব্দুল্লাহ (২৪), মুত্তাকিন (২৪), শাকিল (২৬), নাফিস (২২), হযরত (২২), মানিক (৪৬), সোহাগ (২৭), ফারহান শাফি (১৭), কামরুজ্জামান (২৫), শাহরিয়ার (২৪), রাকিবুল (২৩), বাবুল (২২), রবিউল (২২), কামাল (২১) ও তাহসান (২৪)। অগ্নিদগ্ধদের অন্যদের মধ্যে বর্তমানে কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে জান্নাতুল মাওয়া নামে ১১ বছরের এক শিশু ও শহীদ মনসুর আলী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মেহুরুন্নেসা নামে ১৪ বছরের এক শিশু চিকিৎসাধীন রয়েছে। উত্তরা আধুনিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন একজন (পরিচয়ের তথ্য পাওয়া যায়নি)। হিউম্যান এইড রিসার্চ ল্যাব অ্যান্ড হাসপাতালে তাকরিম হক নামে ১৬ বছরের এক শিশু আইসিইউতে আছে। এভাবেই মৃত্যুর মিছিলে সামিল হচ্ছে নতুন নতুন নিষ্পাপ শিশু। বলতে গেলে আগুনে পুড়ছে আগামীর প্রজন্ম।

সর্বশেষ - আইন-আদালত