তুরস্কে প্রথম দফার ভোটগ্রহণের আগের উত্তাপ এখন অনেকটাই উবে গেছে। শুরুতেই প্রত্যাশিত জয় না পেয়ে অনেকটাই চুপসে গেছেন প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী কেমাল কিলিচদারোগলুর সমর্থকরা। আজ অনুষ্ঠেয় পুনরায় ভোটগ্রহণ নিয়ে তাদের উচ্ছ্বাস-উত্তেজনা অনেকটাই কম। তার পরও বিশেষজ্ঞদের ধারণা, আজকের ভোটগ্রহণের ফলাফলে বড় প্রভাবক হয়ে উঠতে পারে দেশটির অর্থনীতির বর্তমান পরিস্থিতি।
সরকারি তথ্য অনুযায়ী, ক্রমাগত বাড়তে বাড়তে গত বছরের অক্টোবরে তুরস্কে মূল্যস্ফীতির হার ৮৫ শতাংশ পর্যন্ত উঠে গিয়েছিল। সেখান থেকে এ গতি কিছুটা শ্লথ হলেও এখনো সেখানে জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। সর্বশেষ গত এপ্রিলে দেশটিতে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৪৪ শতাংশের কিছু নিচে।
সরকারি এ তথ্যকে সঠিক বলে মানতে নারাজ দেশটির স্থানীয় অর্থনীতিবিদরা। তাদের ভাষ্যমতে, তুরস্কে প্রকৃত মূল্যস্ফীতির হার আরো অনেক বেশি।
বর্তমান প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোগান তুরস্কের ক্ষমতার কেন্দ্রে রয়েছেন দুই দশক ধরে। ২০০৩ সালে প্রথম দেশটির প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ক্ষমতায় আসেন তিনি। এরপর দুই দশক ধরে দেশটির রাজনীতি-অর্থনীতিসহ সবই আবর্তিত হয়েছে তাকে ঘিরে। এরদোগানের প্রধানমন্ত্রিত্ব গ্রহণের সময়ে তুরস্কে প্রতি ডলারের বিনিময় হার ছিল প্রায় দেড় লিরা। এখন ক্রমাগত অবমূল্যায়নের পর তা নেমে এসেছে ২০ লিরারও ওপরে।
৫১ বিলিয়ন ডলারের কিছু বেশি পরিমাণ রিজার্ভ ছাড়া এ মুহূর্তে স্বস্তি দেয়ার মতো আর কোনো খবর নেই তুরস্কের কেন্দ্রীয় ব্যাংক তুর্কিয়ে চুমহুরিয়াত মেরকাজ ব্যাংকাসির (টিসিএমবি) কাছে।
সমালোচক অর্থনীতিবিদদের বক্তব্য হলো তুরস্কের বর্তমান পরিস্থিতি অনেক ভালো হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনার কারণে দেশটির সাধারণ নাগরিকদের জন্য জীবনধারণ এখন অনেক কঠিন হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে দেশটির সুদহার কমিয়ে রাখার নীতি জনসাধারণের জন্য অনেক বড় সংকটের কারণ হয়ে দেখা দিয়েছে। জোর করে সুদহার কমিয়ে রাখার কারণেই তুরস্কে মূল্যস্ফীতি ও লিরার অবমূল্যায়নকে কোনোভাবেই ঠেকানো সম্ভব হচ্ছে না।
তুরস্কে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রথম দফার ভোটগ্রহণ হয় ১৪ মে। এতে মোট ভোটের ৪৯ দশমিক ৫ শতাংশ পান এরদোগান। অন্যদিকে তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী কেমাল কিলিচদারোগলু পেয়েছেন প্রায় ৪৫ শতাংশ ভোট। কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী এককভাবে ৫০ শতাংশ ভোট নিশ্চিত করতে না পারায় দেশটির সংবিধান অনুযায়ী দ্বিতীয় দফায় ভোটগ্রহণের আয়োজন করা হয়, যা আজ অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এ ভোটগ্রহণের মধ্য দিয়েই নির্ধারিত হবে ক্ষমতার মসনদের তৃতীয় দশকে এরদোগান প্রবেশ করতে পারবেন কিনা।
রিসেপ তাইয়েপ এরদোগান বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে পুরনো শাসকদের একজন। প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী পদ মিলিয়ে ২০ বছর ধরে দেশের সর্বোচ্চ ক্ষমতায় আছেন। এ দীর্ঘ সময় ধরে নিজের জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে সমর্থ হয়েছেন তিনি।
কিন্তু তুরস্কের অর্থনীতির বর্তমান পরিস্থিতি তার জন্য বড় চ্যালেঞ্জের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বিশ্লেষকরা আভাস দিয়েছিলেন, ১৪ মে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের সময় ২০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি চ্যালেঞ্জের মধ্যে ছিলেন এরদোগান। ক্ষমতার পালাবদলের কথাও বলছিলেন কেউ কেউ। তবে নির্বাচনী ফলাফলে তেমন কোনো অঘটন ঘটেনি। বিপুল জনসমর্থন নিয়ে জয়ের প্রায় দ্বারপ্রান্তেই ছিলেন তিনি।
এদিকে আজ অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া রান-অফ নির্বাচন নিয়ে তুরস্কে তেমন কোনো উত্তাপ লক্ষ্য করা যায়নি। যেমনটি দেখা গিয়েছিল দুই সপ্তাহ আগের প্রথম ধাপের নির্বাচনে। কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আলজাজিরার প্রতিবেদন বলছে, তুরস্কের প্রেসিডেন্ট শাসিত সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তনের পর এবারই প্রথম নির্বাচনে দ্বিতীয়বারের মতো (রান-অফ) ভোট দিতে যাচ্ছেন দেশটির ভোটাররা।
সোনার ওগোরলু নামের ইস্তানবুলের এক বাসিন্দা জানিয়েছেন, ‘এটি অন্য রকম এক অনুভূতি। আমার মনে হচ্ছে নির্বাচন শেষ। কিন্তু আজ আরেকটি নির্বাচন আছে। আমি অবশ্যই ভোট দেব। কিন্তু বিষয়টি অদ্ভুত লাগছে। কেননা সপ্তাহ দুয়েক আগে পরিবেশ যে রকম ছিল, সে তুলনায় সবকিছু এখন বেশ শান্ত।’
তবে নির্বাচনের প্রথম ধাপে এরদোগানকে ‘ক্ষমতাচ্যুত’ করতে না পারায় দেশটির বিরোধীদলীয় সমর্থকদের অনেকেই এখন বেশ হতাশ। কেমাল কিলিচদারোগলুর এমনই এক সমর্থক বলেন, ‘১৪ মের নির্বাচন নিয়ে অনেক আশা ছিল। ভেবেছিলাম অবশেষে মুক্তি পাব। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে সে অপ্রতিরোধ্য। অর্থনৈতিক সংকটের সমস্যায় সবাই বেশ ক্লান্ত। আবার উদ্দীপনা নিয়ে ভোট দেয়ার বিষয়টি খুবই কঠিন হবে।’
প্রথম দফা নির্বাচনের আগে অধিকাংশ জরিপ বলছিল, এরদোগানের দুই দশকের শাসনের অবসান ঘটতে যাচ্ছে। কেমাল কিলিচদারোগলু হতে যাচ্ছেন পরবর্তী প্রেসিডেন্ট। তবে প্রত্যাশিত ফল না আসায় বিরোধীদের আত্মবিশ্বাস অনেকটাই নড়বড়ে হয়ে গেছে।
বিরোধীদের মনোবল ভেঙে পড়াকে প্রত্যাশিত বলে মনে করেন ইস্তানবুলের সাবানচি বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সহকারী অধ্যাপক বার্ক এসেন। তিনি বলেন, ‘চলমান আর্থিক সংকট ও ভূমিকম্পের পর সরকারের অবহেলা সত্ত্বেও এরদোগান এখনো ৫০ শতাংশের কাছাকাছি সমর্থন নিয়ে আছেন। এখনো এরদোগানের ব্যাপক জনপ্রিয়তা রয়েছে, এটা বিরোধীদলীয় ভোটারদের জন্য সত্যিই হতাশাজনক।’