আমদানি নিয়ে সিদ্ধান্তহীনতার পাশাপাশি বাজার ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতার জেরে নভেম্বরে পেঁয়াজের দাম প্রায় দ্বিগুণ হয়। একই সঙ্গে শীতকালীন সবজির ভরা মৌসুমেও কিনতে হয়েছে উচ্চমূল্যে।
আমদানি নিয়ে সিদ্ধান্তহীনতার পাশাপাশি বাজার ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতার জেরে নভেম্বরে পেঁয়াজের দাম প্রায় দ্বিগুণ হয়। একই সঙ্গে শীতকালীন সবজির ভরা মৌসুমেও কিনতে হয়েছে উচ্চমূল্যে। এর বিরূপ প্রভাব পড়েছে মূল্যস্ফীতিতে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য বলছে, মূল্যস্ফীতি আবারো বেড়েছে নভেম্বরে। পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছে গত বছরের একই মাসের তুলনায় ৮ দশমিক ২৯ শতাংশ, যা অক্টোবরে ৮ দশমিক ১৭ শতাংশ ছিল।
মূল্যস্ফীতির এ হার দিয়ে বোঝায়—গত বছরের নভেম্বরে যে পণ্য বা সেবা ১০০ টাকায় মিলেছে, তা পেতে গত নভেম্বরে খরচ করতে হয়েছে ১০৮ টাকা ২৯ পয়সা। মূল্যস্ফীতি বাড়ার কারণ হিসেবে খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধিকে দায়ী করেছে বিবিএস। সরকারি এ সংস্থাটি নভেম্বরের মূল্যস্ফীতির তথ্য প্রকাশ করেছে গতকাল।
চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে মূল্যস্ফীতি ৬ দশমিক ৫ শতাংশের মধ্যে ধরে রাখার লক্ষ্য ঠিক করেছে সরকার। সেই লক্ষ্য পূরণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নীতি সুদের উচ্চ হার ধরে রেখেছে। তবে কয়েকটি খাদ্যপণ্যের দাম বাড়ায় প্রত্যাশার সঙ্গে বাস্তবতার ব্যবধান আবার বেড়ে গেল। পেঁয়াজ, সবজিসহ যেসব খাদ্যপণ্য নভেম্বরের মূল্যস্ফীতিতে প্রভাব ফেলে সেগুলো চলতি মাসেও না কমে উল্টো বেড়েই চলেছে। গতকালও পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ১৫০ টাকা কেজি। সপ্তাহ দুয়েক আগেও তা ১০০ টাকার নিচে ছিল। ঊর্ধ্বমুখী সবজির বাজারেও স্বস্তি ফেরেনি। বেশির ভাগই বিক্রি হচ্ছে ৮০-৯০ টাকা কেজিতে। কোনো কোনোটি ১০০ টাকার বেশি।
বিবিএসের তথ্য বলছে, খাদ্য মূল্যস্ফীতি অক্টোবরে ৭ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ থেকে বেড়ে নভেম্বরে ৭ দশমিক ৩৬ শতাংশ হয়েছে। অক্টোবরে খাদ্যবহির্ভূত খাতে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৯ দশমিক ১৩ শতাংশ, নভেম্বরে তা খানিকটা কমে হয়েছে ৯ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ। গ্রামাঞ্চলে সার্বিক মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ২৬ শতাংশে, যা অক্টোবরে ছিল ৮ দশমিক ১৬ শতাংশ। এর মধ্যে খাদ্যপণ্যে মূল্যস্ফীতি অক্টোবরে ৬ দশমিক ৯৪ থাকলেও নভেম্বরে বেড়ে হয়েছে ৭ দশমিক ২৭ শতাংশ। আর শহরে সার্বিক মূল্যস্ফীতি অক্টোবরের ৮ দশমিক ৩৩ থেকে বেড়ে ৮ দশমিক ৩৯ শতাংশ হয়েছে। নভেম্বরে খাদ্য মূল্যস্ফীতি শহরে বেড়ে হয়েছে ৭ দশমিক ৬১ শতাংশ, যা অক্টোবরে ৭ দশমিক ৪৫ শতাংশ ছিল।
মূল্যস্ফীতির কারণে খেটে খাওয়া মানুষের পকেটের ওপর চাপ বাড়লেও মজুরি হারের সূচকে কোনো সুখবর নেই। নভেম্বরে মজুরি বৃদ্ধির হার ৮ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ। তার মানে জীবনযাত্রার ব্যয় যে হারে বাড়ছে, মানুষের আয় সেভাবে বাড়ছে না।
বিবিএসের মহাপরিচালক মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, ‘দেশের ৬৪ জেলার বিভিন্ন বাজার থেকে তথ্য নিয়ে আমরা মূল্যস্ফীতি যাচাই করি। তাতে দেখা যাচ্ছে, খাদ্যে মূল্যস্ফীতি কিছুটা বেড়েছে। কারণ গত মাসে বাজারে সবজির দাম কিছুটা বেশি ছিল। তবে গত বছরের এ সময়ের তুলনায় খাদ্যে মূল্যস্ফীতি অনেক কম। নভেম্বরে খাদ্যবহির্ভূত কিছু পণ্যের দামও সামান্য বেড়েছে। এসবের প্রভাবেই অক্টোবরের তুলনায় নভেম্বরে মূল্যস্ফীতির হার কিছুটা বেশি। তবে গত বছরের তুলনায় মূল্যস্ফীতি নিম্নমুখী।’
এ বিষয়ে সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হানবলেন, ‘কয়েক মাস ধরে বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি ৮ শতাংশের ঘরেই আটকে আছে, যা সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক নীতির কার্যকারিতা নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন তুলেছে। মূল্যস্ফীতি সামান্য ওঠানামা হলেও সামগ্রিক প্রবণতায় কোনো দৃশ্যমান পরিবর্তন নেই। সরকার সুদের হার বাড়িয়ে চাহিদা কমানোর চেষ্টা করেছে ঠিকই, কিন্তু এ পরিস্থিতি সামাল দিতে পারছে না। কারণ নীতিগত সমন্বয়, বাজার কাঠামো এবং বাহ্যিক ঝুঁকিগুলোর প্রভাবসহ বহুরূপী চাপে স্থায়ী মূল্যস্থিতি তৈরি হয়নি।’
কৃষি সরবরাহ ব্যবস্থার দুর্বলতার কারণে মূল্যস্ফীতিতে প্রভাব পড়ছে উল্লেখ করে এ অর্থনীতিবিদ আরো বলেন, ‘গত মাসে পেঁয়াজ ও শাকসবজির মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যের মূল্যবৃদ্ধি সামগ্রিক মূল্যস্ফীতিকে আরো তীব্র করেছে। এটি দেখায়, কৃষি সরবরাহ ব্যবস্থা কতটা দুর্বল এবং বাজারে প্রতিযোগিতার অভাব কতটা প্রভাব বিস্তার করে। এ পরিপ্রেক্ষিতে মূল্যস্ফীতি কমাতে হলে কেবল আর্থিক নীতি প্রয়োগ নয়, বরং শক্তিশালী প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার অপরিহার্য।’

















