২০১৭ সাল থেকে দেশের ব্যাংক খাতে আসল পচন শুরু হয়। তখন একটি শিল্পগোষ্ঠীকে দেশের একটা বড় বেসরকারি ব্যাংককে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণের সুযোগ করে দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর আগে পরিস্থিতি অতটা খারাপ ছিল না। মূলত বিশেষ গোষ্ঠীকে সুবিধা দিতে বাংলাদেশ ব্যাংক নিজেই আপসের পথে গেছে। দেশের ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স, বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান ও ব্র্যাক ব্যাংক পিএলসির ম্যানেজিং ডিক্টের সেলিম আর এফ হোসেন ২০ আগস্ট ভার্চ্যুয়াল মাধ্যমে সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন।
২০১৭ সালে আওয়ামী লীগ সরকার রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে ইসলামী ব্যাংককে ‘জামায়াতমুক্ত’ করার উদ্যোগ নেয়। তখন প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা সংস্থাকে ব্যবহার করে ব্যাংকটির মালিকানা ও ব্যবস্থাপনার নিয়ন্ত্রণ নেয় সদ্য বিদায়ী আওয়ামী লীগ সরকারের ঘনিষ্ঠ এস আলম গ্রুপ। এখন ব্যাংকটির এক-তৃতীয়াংশ ঋণই গ্রুপটির স্বার্থসংশ্লিষ্ট। ওই ঘটনার দিকেই ইঙ্গিত করে কথা বলেন এবিবি চেয়ারম্যান।
বর্তমানে ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলো তারল্যসংকটে আছে, এসব ব্যাংকের ক্ষেত্রে কী ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া উচিত, তা সাংবাদিকেরা জানতে চাইলে জবাবে সেলিম আর এফ হোসেন বলেন, আমি যতটুকু বুঝলাম, তাদের স্থিতিশীল করার জন্য প্রাথমিকভাবে এসব ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও বোর্ড পুনর্গঠন করা হবে। ইতিমধ্যে তাদের ঋণ প্রদানের ক্ষমতা কমানো হয়েছে। তিনি বলেন, এসব ব্যাংকে প্রথম যখন সমস্যা তৈরি হয়েছিল, তখনই তা দ্রুত চিহ্নিত করে বিধিনিষেধের আওতায় আনা দরকার ছিল। তা-না করে তাদের টাকা দিয়ে বাঁচিয়ে রাখায় দেশের বিরাট ক্ষতি হয়েছে। এখন এ কঠিন অবস্থা থেকে বের হয়ে আসার দায়িত্ব পড়েছে নতুন সরকারের ঘাড়ে।
ব্যাংক বন্ধ হয়ে গেলে এর প্রভাব কী হবে সাংবাদিকরা তা জানতে চাইলে এবিবি চেয়ারম্যান জানান, বাংলাদেশে এত দিন বড় করে বলা হতো, কোনো ব্যাংককে বন্ধ হতে দিইনি। কিন্তু বাজার অর্থনীতিতে কোনো ব্যাংক খারাপ করলে তাকে বন্ধের দিকে যেতে দেওয়া উচিত। গত ১০ বছরে অনেক ব্যাংকই খারাপ ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত হয়েছে। তাদের স্বাভাবিকভাবে মরতে দিলে জনগণ বুঝতে পারতো তাদের অর্থ কোথায় রাখা নিরাপদ।
বিশিষ্ট ব্যাংকার ব্যক্তিত্ব সেলিম আর এফ হোসেন বলেন, দেশের ব্যাংকিং খাতে পদ্ধতিগত সমস্যা রয়েছে। বিগত সরকারের প্রায় ৭০ শতাংশ সংসদ সদস্য ছিলেন ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পৃক্ত। ফলে তারা সব আইন-কানুন তাদের অনুকূলে করেছেন। সাবেক এক গভর্নরের বরাত দিয়ে সেলিম আর এফ হোসেন বলেন, দেশে ব্যাংক খাতের উদ্যোক্তারা হলেন বড় বড় ব্যবসায়ী। এতে বড় ধরনের স্বার্থের সংঘাত তৈরি হয়েছে। এসব এখন বন্ধ করতে হবে।
এবিবি চেয়ারম্যান সেলিম আর এফ হোসেন বলেন, গত ১০ বছরে ব্যাংক খাতে অনেক নিয়ম ভাঙা হয়েছে। যেমন জোর করে ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ নেওয়া, উপদেষ্টা বানানো, আইন বানিয়ে বন্ড বিক্রি ইত্যাদি। আমাদের নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর আপসের কারণে এমনটা হয়েছে। বড় ব্যবসায়ী গোষ্ঠী ও প্রভাবশালী রাজনীতিকদের সুবিধা দিতে বাংলাদেশ ব্যাংক আপস করেছে।
২০১৯ সালের আরেকটি পরিবর্তন ব্যাংক খাতের খারাপ অবস্থার পেছনে কাজ করেছে বলে জানান সেলিম আর এফ হোসেন। তিনি বলেন, ওই সময় নতুন অর্থমন্ত্রী (আ হ ম মুস্তফা কামাল) আন্তর্জাতিক নীতি থেকে সরে গিয়ে খেলাপি ঋণের নিরাপত্তা সঞ্চিতির নীতিমালা পরিবর্তন করেন। এর ফলে ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে তা ফেরত দেওয়ার অভ্যাসটাই বাংলাদেশ থেকে উঠে গেছে। পুরো দেশে খেলাপি ঋণ বেড়ে যায়। আবার নয়-ছয় সুদহারের নিয়ম করায় পুরো আর্থিক বাজার ধ্বংস হয়েছে, এতে কিছু বড় ব্যবসায়ী সুবিধা পেয়েছেন।