বিগত সরকারের সময়ে বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। দেশে সুশাসন, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি ছিল না। আর্থিক খাতে এত বড় ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে, বাইরে থেকে কল্পনাও করা যাবে না। এত অনিয়ম, এত বিশৃঙ্খলা, এত দুর্নীতি পৃথিবীর আর কোথাও হয়নি। তবে আশাহত হওয়া যাবে না। আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা ফেরাতে অন্তর্বর্তী সরকার স্বল্পমেয়াদি সংস্কারে জোর দিয়েছে। আর মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি সংস্কারের একটা রাস্তা তৈরি করে যাবে। পরবর্তী রাজনৈতিক সরকার এসে তা শেষ করবে। রাজনৈতিক সরকার চাইলেও সংস্কার একেবারে বাদ দিতে পারবে না। ভোটের রাজনীতি করতে গিয়ে বাদ দিতে গেলে জনগণের চাপে পড়বে। ১৬ নভেম্বর আর্থিক এবং অর্থনৈতিক সংস্কার বিষয়ে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় আয়োজিত নীতি সংলাপে প্রধান অতিথির বক্তব্যে অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ এসব কথা বলেন।
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সৈয়দ ফরহাত আনোয়ারের সভাপতিত্বে আলোচনায় বিশেষ অতিথি ছিলেন সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো ও অর্থনীতির ওপর শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রধান ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি কমিশনার ফারজানা লালারুখ এবং ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন এবিবির চেয়ারম্যান ও ব্র্যাক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সেলিম আর এফ হোসেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের সেমিনার কক্ষে এ আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়।
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, বিগত সরকারের সময়ে দেশ থেকে বিপুল অঙ্কের অর্থ পাচার হয়েছে। সাবেক গভর্নর বৈদেশিক মুদ্রাবাজার ঠিক রাখার কথা বলে রিজার্ভের ৪২ বিলিয়ন থেকে ১২ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করে দিয়েছেন। এভাবে রিজার্ভ শেষ করে এখন তিনি মহা আনন্দে কোথায় আছেন জানা নেই। তিনি বলেন, পাচার হওয়া টাকা ফেরত আনার চেষ্টা চলছে। তবে এটি সময়সাপেক্ষ। সরকার একটা বার্তা দিতে চায়, নতুন করে টাকা পাচার করলে ধরা পড়তে হবে। পাচারকারীর বিচার হবে।
অর্থ উপদেষ্টা বলেন, উন্নয়ন কৌশল ভুল ছিল। শুধু প্রবৃদ্ধি, প্রবৃদ্ধি করা হয়েছে। দেখানো হয়েছে রিজার্ভ বাড়ছে, রপ্তানি বাড়ছে, জিডিপি প্রবৃদ্ধি হচ্ছে এবং মূল্যস্ফীতি কম রয়েছে। তবে প্রবৃদ্ধি সবাইকে নিয়ে হয়েছে কিনা, দেখা হয়নি। দেখার দায়িত্ব ছিল নীতি প্রণেতাদের। অন্যদিকে, আর্থিক খাতে স্বচ্ছতা নেই। তার পরও যেটুকু আছে, ভয়ের কিছু নেই। তিনি বলেন, সংস্কার চাইলে কিছু ব্যথা নিতে হবে। সংস্কারের জন্য আর্থিক স্থিতিশীলতা জরুরি। অবশ্য এরই মধ্যে স্থিতিশীলতা কিছুটা এসেছে। ব্যাংক খাত, রাজস্ব ব্যবস্থাপনা, শেয়ারবাজারে কিছুটা শৃঙ্খলা ফিরতে শুরু করেছে। তবে শেয়ারবাজার নিয়ে অনেকে রাস্তায় নেমেছেন। আইসিবিকে এরই মধ্যে ৩ হাজার কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে। আবার সংকটে থাকা কিছু ব্যাংককে এক মাসে ১৮ হাজার কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে। তিনি আরও বলেন, এখন রিজার্ভ থেকে এক টাকাও বিক্রি না করে বাংলাদেশ ব্যাংক আগের বকেয়া পরিশোধ করছে। আশার বিষয় হলো, সরকারের ওপর দেশি-বিদেশি সবাই আস্থা রাখছে। আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক অর্থ দিতে রাজি আছে। আরও একটি সংস্থা বড় অঙ্কের টাকা দিতে চেয়েছিল। তবে সুদহার বেশি হওয়ায় সরকার রাজি হয়নি।
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি প্রসঙ্গে অর্থ উপদেষ্টা বলেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ে সবাই অস্থির হয়ে যাচ্ছেন। সরবরাহ ব্যবস্থায় কিছু ত্রুটি আছে। বগুড়া থেকে কারওয়ান বাজার আসতে ১৭ জায়গায় টাকা দিতে হয়। কিছু জায়গায় মধ্যস্বত্বভোগী দরকার আছে। তবে কেউ কেউ আছে, কিছু না করেই শুধু ফুটপাতে দাঁড়িয়ে চাঁদাবাজি করছে। যে কারণে তিনি চেয়েছিলেন কিছু ডিলার পরিবর্তন করতে। তবে পরিবর্তন করলে আরেক গ্রুপ এসে নাকি চাঁদাবাজি শুরু করবে। রাজনীতিতে সমঝোতা করা কঠিন। তবে চাঁদাবাজিতে সমঝোতা করা খুবই সহজ।
সালেহউদ্দিন বলেন, আমাদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, ক্ষমতা নয়। প্রথমত দেশটা যেভাবে চলছিল, সেটি ঠিক করা। মেরামত করতে সময় লাগবে। আমি তিন সরকারের সময়ে গভর্নরের দায়িত্ব পালন শেষে ২০০৯ সালে বাংলাদেশ ব্যাংক ছেড়েছি। তখন সবাই ফেরেশতা ছিল না। অনেক দাবি ছিল। দিচ্ছি, দেব করে সময় পার করেছি। ওই সময়ে খেলাপি ঋণ ছিল ১৮ হাজার কোটি টাকা। এখন তা আড়াই লাখ কোটি টাকা। এই খেলাপি কেন, কাদের জন্য বেড়েছে সবার জানা।
ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, তথ্য-উপাত্তের রাজনীতিকীকরণ করা হয়েছে। উন্নয়নের যে বয়ান এতদিন শোনানো হয়েছে, তার ব্যবচ্ছেদ করতে না পারলে সামনে এগোনো সম্ভব নয়। কোন পরিস্থিতিতে এই সরকার দায়িত্ব নিয়েছে সবার আগে বুঝতে হবে। জিডিপি প্রবৃদ্ধির যে তথ্য দেওয়া হয়েছিল, তা ছিল ভুয়া। বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ-জিডিপি অনুপাত ১০ বছর ধরে ২৩ শতাংশ। তাহলে এত প্রবৃদ্ধি হলো কীভাবে। এত প্রবৃদ্ধি হলো অথচ কর-জিডিপি অনুপাত বাড়েনি। যেটুকু টাকাপয়সা ছিল তা দৃশ্যমান উন্নয়ন দেখানোর জন্য কিছু খরচ করা হয়েছে। সেখানে অসামঞ্জস্য তৈরি করা হয়েছে।
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, সংস্কারবিরোধী ও দুর্নীতিবাজদের জোট করা হয়েছিল। আর্থিক খাতে অলিগার্ক তৈরি করা হয়েছে। অলিগার্করা ব্যাংক, জ্বালানি, শেয়ারবাজার সব জায়গায় সক্রিয় ছিল। তারা আর্থিক খাত ও জ্বালানি খাত পুরো খেয়ে ফেলেছে। যারা ব্যাংক খাত খেয়েছে, তারাই জ্বালানিতে সক্রিয় ছিল, তারাই আবার মেগা প্রকল্পে ছিল। তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক অভ্যন্তরীণ তথ্য-উপাত্ত এবং পরিদর্শন দুইভাবে ব্যাংক খাত তদারক করে। জানি না যিনি এসব ধ্বংস করেছেন তিনি এখন কোথায় আছেন। তিনি দিনে বলেছেন আইএমএফের শর্ত মানছেন, রাতে টাকা ছাপিয়েছেন। দেখিয়েছেন রিজার্ভ বাড়ছে, সেই হিসাবে গন্ডগোল। কেন্দ্রীয় ব্যাংকই সবচেয়ে সংকট সৃষ্টি করেছে। এখন পরিষ্কার হয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের লোকজন অলিগার্কদের কাছ থেকে মাসোহারা নিয়েছে।
ড. দেবপ্রিয় বলেন, যাদের দেখভালের দায়িত্ব তারা যদি দেখভাল না করে তাহলে চলবে কীভাবে। বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে নতুন ব্যাংকের দরকার নেই। অথচ প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে যোগ্যতা নেই, এমন ব্যক্তিকে ব্যাংক দেওয়া হলো। বিচার বিভাগের প্রতি সম্মান রেখে বলতে চাই, তিনজন এক হয়ে দেশটাকে আজকের এ পর্যায়ে নিয়ে এসেছেন। তিনি বলেন, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষা করতে না পারলে সংস্কারের পথে এগোনো যাবে না। এই স্থিতিশীলতা থাকতে হবে ডলারের দরে, সুদহারে ও মূল্যস্ফীতিতে। না হলে সংস্কারে মানুষ স্বস্তি পাবে না। আবার ১৫ বছরের সংস্কার যদি ১৫ মাসে করতে না পারা যায়, তাহলে গণতন্ত্র বাধাগ্রস্ত হবে। অবশ্য এর মধ্যে যেসব উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তা ঠিক পথেই আছে।
ফারজানা লালারুখ বলেন, শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়ন এবং কিছু মানুষকে সুবিধা দিতে কাজ করেছে। সুশাসন, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার ব্যাপক ঘাটতি তৈরি করা হয়েছে। বাজারকে আস্থাহীনতার এমন এক জায়গায় নেওয়া হয়েছে, সংস্কার ছাড়া আস্থা ফেরানো সম্ভব নয়।
সেলিম আর এফ হোসেন বলেন, গত ১৫ বছরে আর্থিক খাতে ব্যাপক অনৈতিক চর্চা হয়েছে। ফ্যাসিবাদের সময়ে সুশাসন ঘাটতি ও আইনের শাসনের ব্যাপক ঘাটতি তৈরি হয়েছে। এ অবস্থার উন্নয়নের জন্য সংস্থার অত্যন্ত জরুরি।