‘শত্রু তুমি, বন্ধু তুমি; তুমি আমার সাধনা/
তোমার দেয়া আঘাত আমায় দেয় যে মধুর বেদনা’
জাতিসংঘ সারাবিশ্বে ৩০ জুলাই ‘বিশ্ব বন্ধু দিবস’ পালন করে। উদ্দেশ্য- সম্প্রীতির বিস্তার ঘটানো। বন্ধুত্ব জনে জনে, দেশে দেশে। মানুষের মধ্যে মানসিক, সামাজিক দূরত্ব কমিয়ে আনা। এই দিন বন্ধু-বান্ধবীরা একত্রে মিলিত হয়। ইউরোপের সংস্কৃতি অনুযায়ী তারা কার্ড বিনিময় করে। মিষ্টিমুখ করায়, উপঢৌকন দেওয়া-নেওয়াসহ ফ্রেন্ডশিপ ব্যান্ড বিনিময় করে। প্রারম্ভিক ইতিহাস যতটুকু জানা যায়, ১৯৩০ সালে হলমার্কস কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা Jozce Hall প্রথম ২ আগস্ট ‘বিশ্ব বন্ধু দিবস’ হিসেবে পালনের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। ধীরে ধীরে এই দিনের গুরুত্ব লোকজনের কাছে কমে যায়। লোকজন এটা কোম্পানির ব্যবসায়িক কৌশল মনে করতে থাকে। এরপর ১৯৫৮ সালে ‘ওয়ার্ল্ড ফ্রেন্ডশিপ ক্রুসেড’ নামের একটি আন্তর্জাতিক বেসরকারি সংস্থা ৩০ জুলাই দিনটি ‘বিশ্ব বন্ধু দিবস’ হিসেবে পালনের প্রস্তাব করে। ব্যাপক প্রচারণার উদ্যোগ গ্রহণ করে সংস্থাটি। এপ্রিল ২০১১ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ অফিসিয়ালি ৩০ জুলাই ‘বিশ্ব বন্ধু দিবস’ ঘোষণা করে। আমাদের দেশে ‘বিশ্ব বন্ধু দিবস’ নিয়ে তেমন ব্যাপক কোনো আয়োজন চোখে পড়ে না। যদিও কোনো উদ্দেশ্য সামনে রেখে ব্যক্তিবিশেষের উদ্যোগে একটি মহল সর্বশক্তি নিয়োগ করে ভালোবাসা দিবস বাংলাদেশে ব্যাপকভাবে প্রচলনের ব্যবস্থা করে। কিন্তু সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠা, পারস্পরিক বন্ধুত্বের বন্ধন জোরালো করার প্রচেষ্টা কোনো মহল থেকেই গ্রহণ করতে দেখা যায়নি।
৩০ জুলাই ‘বিশ্ব বন্ধু দিবস’। বন্ধু মানেই বান্ধব, বান্ধবী- যাদের কাছে নিজেকে বিনা শর্তে মেলে দেওয়া যায়। প্রাণ খুলে দেওয়া যায়। মানসিক আশ্রয়, প্রশ্রয়, সহায়তা ও সহমর্মিতার প্রধান জায়গা বন্ধুত্ব। বন্ধুত্ব এক সময় ছিল সমবয়সীদের মধ্যে বা কাছাকাছি বয়সের মানুষের সঙ্গে মানুষের। বেশি বয়সের একজনের সঙ্গে কম বয়সী কারো বন্ধুত্বের ঘটনাও বিরল নয়। তবে খুব কম দেখা যেত। সৌদি আরবে সীমিত অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণে দেখেছি, অসম বয়সের বন্ধুত্ব সাধারণ এবং সমাজে বহুল প্রচলিত। বিশেষত এরা নারী-পুরুষ সম্পর্ক নিয়ে খোলামেলা কথাবার্তা, রস-রসিকতা করতে অভ্যস্ত। শুনেছি, বিয়ের পরদিন অভিভাবকরা নববিবাহিতার কাছে স্বামীসঙ্গ ঠিক আছে কি-না স্বাভাবিক কুশলাদির মতোই জিজ্ঞেস করেন, জানতে চান। এখন তো বলা হচ্ছে, বাবা মা-ই প্রধান ও প্রথম বন্ধু। সন্তানের সঙ্গে অভিভাবকের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক জীবন গঠনে বিশেষ ভূমিকা পালন করে।
ঢাকার গুলশানে হলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলার সময় এক কিশোর জীবনকে অত্যন্ত তুচ্ছ বিবেচনা করলো বন্ধুত্বের জন্য। উৎসর্গ করলো নিজের জীবন। এমন ঘটনা সমাজে, পরিবারে, দেশে-দশে অহরহ দেখা যায় না। কালে কালে এমন দু’-একটি ঘটনা ইতিহাস তৈরি করে। হলি আর্টিজানে জঙ্গিরা আটককৃত বন্দিদের পরিচয় নিয়েছে। মুসলিম ফরাজ-এর সঙ্গে ওই রেস্টুরেন্টে গিয়েছিল কয়েকজন অমুসলিম বান্ধব, বান্ধবী। জঙ্গিরা ফরাজকে মুক্তি দিয়ে চলে যেতে বলে। সে চেয়েছে বন্ধুদেরও মুক্তি। শেষ পর্যন্ত বন্ধুদের ছেড়ে না দেওয়ায় ফরাজ নিজেও তাদের সঙ্গে থেকে যায়। জঙ্গিরা অন্যদের সঙ্গে তাকেও গুলি করে হত্যা করে। বাংলা সাহিত্যে বন্ধুবান্ধব নিয়ে যথেষ্ট চর্চা হয়েছে। দেশে-বিদেশেও সাহিত্য, চলচ্চিত্র, সামাজিক জীবনে নানাভাবে বন্ধুত্বের কীর্তন হয়েছে। বন্ধুত্বের সম্পর্কে কোনো বিনিময়ের শর্তযুক্ত প্রাপ্তির প্রত্যাশা থাকে না বলেই এই সম্পর্ক ভিন্নমাত্রায় মানুষের জীবনে প্রভাব বিস্তার করে।
উপরে উদ্ধৃত গানের চরণে আমরা দেখেছি- যিনি বন্ধু, তিনিই শত্রু। তার দেওয়া আঘাত কষ্টদায়ক, কিন্তু সে কষ্ট মধুময়, সেই যন্ত্রণায় এক ধরনের আনন্দ আছে। শরৎচন্দ্রের ইন্দ্র এবং শ্রীকান্তের মধ্যে বন্ধুত্ব দেখেছি, ‘গৃহদাহ’ উপন্যাসে মহিম ও সুরেশের বন্ধুত্ব দেখেছি। রবীন্দ্রনাথের ‘গোরা’সহ অন্যান্য উপন্যাসেও বন্ধুত্ব আছে কাহিনীর অনেক অংশ জুড়ে। একালের অনেক লেখকের বইতে বন্ধুত্ব- বিশেষ মর্যাদার সঙ্গে চিত্রিত। বন্ধুত্বের ঘটনা জানা যায় মাইকেল মধুসূদন দত্ত ও রাজনারায়ণ বসুর মধ্যে। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর আর মধুসূদন দত্তের বন্ধু সম্পর্ক ঐতিহাসিক ঘটনারও অধিক কিছু। বিদ্যাসাগর মাইকেলকে প্রচুর আর্থিক সহযোগিতা করেছেন বিনিময় প্রত্যাশা না করে। এমনকি ইতালির ভার্সাই থেকে স্বদেশে ফিরে আসার রাহা খরচ জুগিয়েছেন বিদ্যাসাগর। তা না হলে আমরা মাইকেল মধুসূদনের অমর সৃষ্টির সম্ভার থেকে বঞ্চিত হতাম। বন্ধুকে নিয়ে আমাদের লোকসাহিত্যের কাহিনী বা কিচ্ছা, গল্পে প্রচুর উপাদান পাওয়া যায়। ‘রাখাল বন্ধু’ নামে একটি জনপ্রিয় লোককাহিনী চলচ্চিত্রায়িত হয়েছে। নামকরণ থেকেই বোঝা যায় সামান্য রাখাল, বন্ধুত্বের সম্পর্কের মর্যাদা কত উঁচু পর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত করেছে। তার গুণ-কীর্তন করেই বন্ধুত্বের গল্প তৈরি হয়েছে। ‘সুয়োরানী দুয়োরানী’ নামে একটি চলচ্চিত্রে রাজপুত্রের বন্ধু হিসেবে দেখা যায় একজন রাখাল। রাজপুত্রের দুঃখে, রাজপুত্রের সুখে সেই রাখাল বন্ধু একাত্মবোধ করেছে। বন্ধুকে তার বিপদ থেকে উদ্ধারে নিজের জীবন বিপন্ন করে সাহায্য করেছে। বন্ধুত্ব কখনো কখনো স্বার্থের কারণে সম্পর্কের গুরুত্ব হারায়। আধুনিক জমানায় বন্ধুত্ব অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বোধ করি দেওয়া-নেওয়া সম্পর্কের উপর ভিত্তি করে তৈরি হয়। কখনো তা হিংসাত্মক পর্যায়ে পর্যবসিত হয়। হিংসা এক পর্যায়ে গিয়ে জিঘাংসায় পরিবর্তিত হয়। সাম্প্রতিককালে পত্রিকার পাতা খুললেই আমরা দেখব সমাজের অভ্যন্তরে নিঃস্বার্থ চেতনা বোধের লালন, পোষণ, চর্চা আগের মতো নেই। আত্মস্বার্থ চেতনা সমাজ জীবনকে অনেক ক্ষেত্রেই অসহিষ্ণু, বিশৃঙ্খল, অভাবিত পরিস্থিতির মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। বিখ্যাত লেখকদের বন্ধুত্বের পাশাপাশি বিদ্বেষের কথাও জানা যায়। সেই দূষিত সম্পর্কের বহিঃপ্রকাশও বুদ্ধিবৃত্তিক বা সাহিত্যিক রুচিশীলতার গুণে সমাজ মানস চমকিত করে, বিশিষ্ট মর্যাদা পায়। যেমন বিখ্যাত ফরাসি লেখক আঁদ্রে জিদ একবার তার বন্ধুদের আচরণে খুব নাখোশ হয়েছিলেন। উপযুক্ত জবাব দেওয়ার উপায় বের করেছিলেন। তাঁর সংগৃহীত পুস্তকের এক বড় অংশ বিক্রি করবেন জানিয়ে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিলেন। বন্ধুরা জানতেন আঁদ্রে জিদের সমৃদ্ধ লাইব্রেরির বহু মূল্যবান গ্রন্থ সংগ্রহ সম্পর্কে। তাই বই কেনার আগ্রহ নিয়ে বন্ধুরা নিলামে বলা যায় হুমড়ি খেয়ে পড়লেন। নিলামে এসে দেখলেন যে, বিগড়ে যাওয়া বন্ধুদের বইগুলি কেবল বিক্রির জন্য রাখা আছে। এই লেখকগণ সময় সময়ে তাদের প্রকাশিত বই-পুস্তক আঁদ্রে জিদকে উপহার হিসেবে দিয়েছেন, সেই বইগুলি তিনি অপ্রয়োজনীয় বিবেচনা করে বিক্রির জন্য নিলামে উঠিয়েছেন। এই উপায়ে ওই বন্ধুদের বিরোধিতার চরম রুচিশীল জবাব দিয়েছিলেন। এই উচ্চমানের অপমান হজম করতে সেই লেখকদের কি পরিমাণ বেদনা-যাতনা হয়েছিল তা হয়তো আমরা অনুমান করতে পারি।
সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ ও সংবাদমাধ্যমে খবর প্রচারিত হয়েছে যে, ইলন মাস্ক তার বিশিষ্ট বন্ধুর স্ত্রীর সঙ্গে বিশেষ সম্পর্ক স্থাপন করেছেন। তাতে সংসারে ভাঙন সৃষ্টি হয়েছে। যদিও ইলন মাস্ক তা অস্বীকার করেছেন। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের এক মন্ত্রীর বান্ধবীর বাড়িতে প্রায় ৫০ কোটি টাকার কাগজের নোটসহ স্বর্ণের বার, গয়নাগাটি পাওয়া গেছে। বান্ধবী এখানে মন্ত্রী বন্ধুকে সহযোগিতা করেছে, অন্য বৈষয়িকতার কথা না তুলেও বলা যায়। আজকাল স্বার্থ এবং সুবিধার বেড়াজালে বন্ধুত্বের সম্পর্কের মধ্যে ক্রমশ কালিমার অপচ্ছায়া যুক্ত হচ্ছে। এই ব্যবস্থা মানুষের সম্পর্কের গভীরতা নষ্ট করছে, যুক্তস্বার্থপরতা নির্মল বন্ধুত্বের সম্পর্কের মাঝে। মোগল বাদশা হুমায়ূনের বন্ধু বৈরাম খাঁ’র কথা ইতিহাস বিদিত। তিনি সম্রাট আকবরকে রাজকার্য ভার বুঝে নেওয়ার আগ পর্যন্ত সব রকম প্রতিকূলতা থেকে আগলে রেখেছেন। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে এক বন্ধুর অভিজ্ঞতায় জেনেছি, একজন লম্বা মানুষের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয় একজন খাটো ব্যক্তির। মোটা মানুষের সঙ্গে বন্ধুত্ব¡ চিকন মানুষের। বন্ধুত্ব গায়ের রঙের দিক থেকে বিবেচনা করলে ফরসা রঙের গড়ে উঠে একটু গাঢ় রঙের মানুষের। আকর্ষণীয় চেহারার একজনের সঙ্গে দেখতে অনাকর্ষণীয় মানুষের বেশ ভালো বন্ধুত্ব দেখা যায়।
শহরের কথা জানি না, কিন্তু গ্রামে কয়েক দশক আগেও ছেলেদের মধ্যে ‘দোস্ত’ পাতানো, মেয়েদের মধ্যে ‘সই’ পাতানোর চল ছিল। আর এই পাতানো সম্পর্ক ছিল পারিবারিক বন্ধনের নামান্তর, রক্তের সম্পর্কের চেয়েও এই সই এবং দোস্ত সম্পর্ক ছিল নিবিড়। অনুষ্ঠান করেও দোস্ত ও সই পাতানো উপভোগ করা হতো। পারিবারিক সম্পর্কের ভেতরেও অনেক সময় প্রগ্রাঢ় বন্ধুত্ব সৃষ্টি হয়। মামাতো, ফুফাতো, খালাতো, চাচাতো- এইরকম পারিবারিক সম্পর্কের ভাই, বোন, মামা, চাচা, খালা এদের মধ্যেও ঘনিষ্ঠ অকৃত্রিম বন্ধুত্ব সৃষ্টি হতে দেখা যায়। আত্মীয়তার বন্ধন ছাপিয়ে এইসব ক্ষেত্রে বন্ধুত্বই প্রধান। ইদানীং ছেলেদের মধ্যে মেয়েবন্ধুকে কেন্দ্র করে অথবা সামান্য আর্থিক লেনদেন অজুহাত হিসেবে নিয়ে বন্ধু কর্তৃক বন্ধু হত্যার ঘটনা আতঙ্কের বিষয় হয়ে উঠেছে। সমাজ পরিবার ব্যক্তি সচেতন না হলে, নির্মল সম্পর্কের ভালোলাগা, ভালোবাসা, স্বার্থহীন ত্যাগের মহিমার মর্যাদা সমাজ দেহ থেকে অপসারিত হয়ে যাবে। সমাজদেহে এক ধরনের দুষ্ট ক্ষতের সৃষ্টি হবে। এখন দরকার সবাই মিলে পারস্পরিক দূরত্ব ঘুচিয়ে বন্ধুত্বের অপ্রতিহত জয় ঘোষণা করা। সমাজে, দেশে, বিদেশে, জাতিতে, ধর্মে, বর্ণে, জীবনের সকল ক্ষেত্রে প্রীতিময় বন্ধু-সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা, চর্চা ও সুরক্ষার অঙ্গীকার, প্রত্যয় গ্রহণ করার মধ্য দিয়ে মানুষের সঙ্গে মানুষের দূরত্ব, বিভেদ, বৈষম্য দূর করা সম্ভব।
করিম রেজা : কবি-কথাশিল্পী ও কলামিস্ট