১০ মার্চ ২০২৫, এখন সময় দুপুর ১:০৬ মিনিট
শিরোনাম
  1. অন্যান্য
  2. অর্থনীতি
  3. আইন-আদালত
  4. আন্তর্জাতিক
  5. কৃষি
  6. খুলনা
  7. খেলাধূলা
  8. গণমাধ্যম
  9. চট্রগ্রাম
  10. জাতীয়
  11. ঢাকা
  12. তথ্য-প্রযুক্তি
  13. ধর্মতত্ত্ব
  14. প্রকৃতি-পরিবেশ
  15. প্রবাস জীবন

কেমন আছে দেশের অর্থনীতি

প্রতিবেদক
এ কে নাহিদ
জানুয়ারি ৩০, ২০২৫ ৪:৩৫ অপরাহ্ণ

সময়ের পরিক্রমায় পুরাতন বছর বিদায় নেয়, নতুন বছর আসে। এটি প্রকৃতির নিয়ম। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আন্ন্দ-বেদনার মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলে দেশের অর্থনীতি ও মানবজীবন। বিদায়ী বছরের মধ্য দিয়ে মানুষ নতুন বছরকে বরণ করে নেয়, শুরু হয় অর্থনীতির নতুন সমীরণ। বিদায়ী বছরে কেমন ছিল দেশের অর্থনীতি? সূচক বলছে, ভালো ছিল না। তবে তথ্য-উপাত্তের মাধ্যমে সূচক নির্ধারিত হয়। যেহেতু আগের তথ্য-উপাত্ত বা পরিসংখ্যানের স্বচ্ছতা ও সঠিক তথ্য নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। তাই অর্থনীতি আগের চেয়ে ভালো নাকি মন্দ, তা পর্যালোচনা কঠিন। তবে আগের সঙ্গে তুলনায় না গিয়েও বলা যায়, ২০২৪ সালের অর্থনীতি দুর্দশার মধ্যে ছিল। অবশ্য ২০২৩ সালেও অর্থনীতি ভালো অবস্থায় ছিল না। অর্থনীতিতে নানা সংকটের মধ্যে ২০২৩ সাল শুরু হয়েছিল। ওই বছর মূল্যস্ফীতি বাড়ছিল ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পতন চলছিল। ২০২৪ সালের শুরুতে এক তরফা নির্বাচনে আওয়ামী লীগ টানা তৃতীয়বারের মতো সরকার গঠন করে। নতুন সরকার অর্থনীতিকে টেনে তুলতে কঠিন সংস্কারে রাজি হয়ে আইএমএফের ঋণ নেয়। তার পরও পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। রিজার্ভ কমতে থাকে। ডলারের দাম বৃদ্ধির চাপ তৈরি হয়। ডলার সংকটে সরকারের জরুরি আমদানিও বাধাগ্রস্ত হয়। সার ও জ্বালানি আমদানিতে মেয়াদোত্তীর্ণ বকেয়া বাড়তে থাকে। আন্তর্জাতিক ক্রেডিট রেটিং এজেন্সিগুলো বাংলাদেশের ঋণমান কমাতে শুরু করে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের অর্থনীতির দুর্বলতা প্রকাশ হতে থাকে। অন্যদিকে গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের আগে-পরে বেশ কিছুদিন অর্থনীতির স্বাভাবিক কার্যক্রম বিঘিœত হয়। ফলে অর্থনীতির কার্যক্রমে গতি কমে। এর সঙ্গে বাজারে জিনিসপত্রের উচ্চ মূল্য মানুষকে বিশেষত দরিদ্র ও নির্ধারিত আয়ের জনগোষ্ঠীর জীবিকার সংকট আগের চেয়ে কঠিন করে তোলে। আর্থিক খাতে বিশেষত ব্যাংক ও পুঁজিবাজারের দুর্দশার চিত্র আরও স্পষ্ট হয়। রাজনীতি, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিসহ নানা অনিশ্চয়তার কারণে বিনিয়োগ এক প্রকার থমকে যায়। শিল্পাঞ্চলে অশান্ত পরিস্থিতি তৈরি হয়। ব্যবসা-বাণিজ্যে দেখা দেয় ধীরগতি। তবে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ দৃশ্যমান। ব্যাংকগুলোর প্রকৃত পরিস্থিতি যাচাই চলছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। সরকার গঠিত শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি অর্থনীতির ওপর একটি বিস্তারিত প্রতিবেদন দিয়েছে। পুঁজিবাজারে সংস্কার শুরু হয়েছে। উন্নয়ন প্রকল্পে অপ্রয়োজনীয় ব্যয় পরিহারের সিদ্ধান্ত হয়েছে। সরকার পরিচালন ব্যয়ে লাগাম টেনেছে। সংস্কারের ফলে আগামীতে অর্থনীতি ভালোর দিকে যাওয়ার ইঙ্গিত রয়েছে। বিভিন্ন সংস্কার উদ্যোগ বছরের শেষ দিকে এসে মানুষকে আশা জাগিয়েছে। এরই আলোকে বিদায় ২০২৪ নবযাত্রায় ২০২৫, কেমন আছে দেশের অর্থনীতি। এইসব নিয়েই এবারের টাইমওয়াচ প্রচ্ছদ প্রতিবেদন; লিখেছেন কে নাহিদ
সংকট শুরুর প্রেক্ষাপট
বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতিতে কভিডের আগে দীর্ঘ সময় এক ধরনের স্থিতিশীলতা ছিল। উচ্চ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ছিল এবং মোটামুটি নিয়ন্ত্রণে ছিল মূল্যস্ফীতি। অন্তত তিন বছর ধরে সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতায় ফাটল দেখা যাচ্ছে। প্রবৃদ্ধি কম হচ্ছে, অন্যদিকে মূল্যস্ফীতি বাড়ছে।
কেন এ পরিস্থিতি হলো? পেছন ফিরলে দেখা যাবে, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর বিশ্বজুড়ে সরবরাহ চেইনে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। এর প্রভাবে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বৈশ্বিক সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। মূল্যস্ফীতি সামাল দিতে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের বেশির ভাগ প্রভাবশালী দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদের হার বাড়ানোর নীতি নেয়। সারাবিশ্ব থেকে বড় অঙ্কের পুঁজি উচ্চ সুদের দিকে ধাবিত হয়। কিন্তু বাংলাদেশ তখনও সুদের হার নির্দিষ্ট সীমায় বেঁধে রাখে। এর সঙ্গে বাজার ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা মিলে মূল্যস্ফীতি বাড়তে থাকে। অনেক দেশ ২০২৩ সালের মধ্যে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনে। কিন্তু ব্যর্থ হয় বাংলাদেশ।
বাংলাদেশ ব্যাংক ২০২২ এবং ২০২৩ সালের পুরোটা সময় কৃত্রিমভাবে ডলারের দর আটকে রাখে। কিন্তু আইএমএফের ঋণ নেওয়ার শর্ত মানতে এক পর্যায়ে খানিকটা বাজারের ওপর ছেড়ে দেয়। তখন এক লাফে ডলারের দর অনেক বাড়ে, যা মূল্যস্ফীতিকে আরও উস্কে দেয়। ২০২৪ সালজুড়েই সাধারণ মূল্যস্ফীতি গড়ে ১০ শতাংশের মতো ছিল। খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল আরও বেশি। কোনো কোনো মাসে তা ১৪ শতাংশে পৌঁছে যায়। গত এক যুগে এত উচ্চহারে মূল্যস্ফীতি দেখা যায়নি।


সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক প্রকৃত পরিস্থিতি আড়াল করে ‘কিছুদিনের মধ্যে সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে’-এমন বার্তা দিতে থাকে। কিন্তু গত এপ্রিলে এসে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার নিট রিজার্ভ ১৩ বিলিয়ন ডলারের (আইএমএফের হিসাব) নিচে নামে। সবাই টের পান, অর্থনীতির সংকট খুব তীব্র। এমন পরিস্থিতিতে শুরু হয় চাকরিতে কোটা বাতিলের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন, যা এক পর্যায়ে গণআন্দোলনে রূপ নিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটায়। সম্প্রতি ঢাকায় সরকারের সঙ্গে সিরিজ বৈঠক শেষে আইএমএফের একটি মিশনের বিবৃতিতে বলা হয়, গণঅভ্যুত্থানের কারণে সৃষ্ট ক্ষয়ক্ষতি, বন্যা এবং সংকোচনমূলক নীতির প্রভাবে বাংলাদেশে চলতি অর্থবছরে মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি কমে যাবে। অন্যদিকে মূল্যস্ফীতি আরও বাড়বে।
জুলাই পরবর্তী পরিস্থিতি
জুলাই ও আগস্টে অর্থনৈতিক কার্যক্রম চরম বিঘিœত হয়। জুলাইয়ে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১৪ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়। আগস্টে বিভিন্ন কারখানায় ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। এর পর দেশজুড়ে শুরু হয় বন্যা। কয়েক মাস ধরে শিল্পাঞ্চলে বেতন বৃদ্ধি ও অন্যান্য দাবিকে কেন্দ্র করে অশান্ত পরিস্থিতি রয়েছে। তবে এর মধ্যে রেমিট্যান্সের অবস্থা খুবই ভালো। রপ্তানিতেও মোটামুটি প্রবৃদ্ধি রয়েছে। ফলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। বছর শেষে মোট রিজার্ভ বেড়ে ২১ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য মতে, গত জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত নিট বিদেশি বিনিয়োগ বা এফডিআই কমেছে প্রায় ২০ শতাংশ। গত অর্থবছরে কমেছিল প্রায় ১১ শতাংশ। দেশি বিনিয়োগের হালনাগাদ পরিসংখ্যান নেই। তবে মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি প্রবণতা থেকে স্থানীয় নতুন বিনিয়োগের পরিস্থিতি কিছুটা অনুধাবন করা যায়। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান বলছে, আলোচ্য চার মাসে মূলধনি যন্ত্রপাতির আমদানি ২৫ শতাংশ কমেছে। এ ছাড়া মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি বিদেশি ঋণ এসেছে ১০১ কোটি ডলার, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৩৫ শতাংশ কম। অন্যদিকে বিদেশি ঋণ পরিশোধ ৩৯ শতাংশ বেড়ে ৯২ কোটি ডলারে দাঁড়িয়েছে।
অন্তর্বর্তী সরকার চাল, ভোজ্যতেলসহ আরও কয়েকটি নিত্যপণ্য আমদানিতে শুল্ক-কর কমিয়েছে। এলসি মার্জিন কমানোসহ আমদানিতে সহায়তার কিছু পদক্ষেপও নেওয়া হয়েছে। কিন্তু এসব পদক্ষেপে জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধি ঠেকানো যাচ্ছে না। সর্বশেষ গত নভেম্বর মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি হয়েছে ১৩ দশমিক ৮০ শতাংশ। আগস্ট মাসে যখন রাজনৈতিক পটপরিবর্তন ঘটে, অর্থনীতি তখন রীতিমতো সংকটে। চাপ সামলাতে অন্তর্বর্তী সরকার কিছু পদক্ষেপ নিলেও গত প্রায় পাঁচ মাসে গতি পায়নি অর্থনীতি। এই সময়ে সবচেয়ে বড় অর্জন হলো- অর্থনীতির সংকটকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। শ্বেতপত্রের মাধ্যমে অর্থনৈতিক পরিস্থিতির যে ব্যবচ্ছেদ করা হয়েছে, তাতে আওয়ামী লীগের ব্যাপক লুটপাটের চিত্রও উঠে এসেছে। এখনো উচ্চ মূল্যস্ফীতির মধ্যে সাধারণ মানুষ পিষ্ট হচ্ছেন। ডলারের দাম ১২০ টাকা ছাড়িয়ে গেছে। কিছুটা ইতিবাচক আছে রপ্তানি ও প্রবাসী আয়। তবে সামষ্টিক অর্থনীতির বাকি প্রায় সব সূচকই তলানিতে। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তায় বিনিয়োগ স্থবির হয়ে রয়েছে। জুলাই-আগস্টের গণ-আন্দোলনের পর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়নি। ফলে শিল্প খাত, বিশেষ করে তৈরি পোশাক খাতে অস্থিরতা কাটছে না। চাঁদাবাজি চলছে, চাঁদাবাজ বদলেরও খবর পাওয়া যাচ্ছে। সার্বিকভাবে বলা যায়, অর্থনীতিকে সংকটে রেখেই বিদায় নিয়েছে ২০২৪, এখন নবযাত্রায় নতুন বছর ২০২৫। ৫ আগস্ট ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর অর্থনৈতিক নেতৃত্বেও বড় পরিবর্তন হয়েছে। অর্থ উপদেষ্টা, পরিকল্পনা উপদেষ্টা, বাণিজ্য উপদেষ্টার পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর, এনবিআর চেয়ারম্যানসহ বড় বড় পদে স্বচ্ছ ভাবমূর্তির ব্যক্তিদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। আগের সরকারের রেখে যাওয়া ‘জঞ্জাল’ সরাতেই অর্থনৈতিক নেতৃত্ব মূলত গত পাঁচ মাস ব্যস্ত ছিলেন। সংকটকবলিত একটি অর্থনীতি নিয়েই ২০২৪ সালের যাত্রা শুরু হয়েছিল। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অর্থনীতি এখন গতি হারিয়েছে।


বছরের বড় ভিলেন মূল্যস্ফীতি
বিদায়ী বছরে সাধারণ মানুষ সবচেয়ে বেশি ঋণগেছেন নিত্যপণ্যের মূল্য নিয়ে। টানা আট মাস খাদ্য মূল্যস্ফীতি দুই অঙ্কের ঘরে। এমনকি শীতের এ মৌসুমে সরবরাহ বাড়লেও শাকসবজির দাম খুব বেশি কমেনি। ফলে সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন নির্দিষ্ট আয়ের মানুষেরা। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ হিসাবে, গত নভেম্বর মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৩ দশমিক ৮০ শতাংশ, যা গত সাড়ে ১৩ বছরের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি। গত জুলাই মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১৪ দশমিক ১০ শতাংশে উঠেছিল।
সার্বিক মূল্যস্ফীতি দুই অঙ্কের ঘরের আশপাশেই থেকেছে। কিন্তু জাতীয় মজুরি হার কয়েক মাস ধরেই ৮ শতাংশের ঘরে আটকে আছে, অর্থাৎ মূল্যস্ফীতির তুলনায় মানুষের আয় কম হারে বাড়ছে। ক্ষমতায় নতুন সরকার আসার পর সুদের হার বাড়িয়ে, কিছু শুল্ক কমানোসহ অন্যান্য পদক্ষেপ নিলেও মূল্যস্ফীতির রাশ টেনে ধরা যায়নি।
শ্বেতপত্রের দর্পনে অর্থনীতির করুণ চিত্র
২০২৪ সালের অন্যতম বড় উদ্যোগ ছিল অর্থনীতি নিয়ে শ্বেতপত্র প্রকাশ। পদে পদে দুর্নীতির কারণে পরিস্থিতি কতটা খারাপ হয়েছে, তা উঠে এসেছে প্রথমবারের মতো নেওয়া এই উদ্যোগে। বলা হয়েছে, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে প্রায় ২৮ লাখ কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়েছে, গড়ে প্রতিবছর গেছে ১ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। দেড় দশকে সরকারি কেনাকাটা থেকে আড়াই লাখ কোটি টাকা ঘুষ খেয়েছেন রাজনীতিবিদ ও আমলারা। উন্নয়ন প্রকল্প থেকে প্রকল্প থেকে লুটপাট হয়েছে পৌনে তিন লাখ কোটি টাকা। আর শেয়ারবাজার থেকে আত্মসাৎ করা অর্থের পরিমাণ এক লাখ কোটি টাকা।
ধুঁকে ধুঁকে চলছে রাজস্ব খাত
ধুঁকে ধুঁকে চলছে রাজস্ব খাত। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাময়িক হিসাবে, চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) সময়ে শুল্ক-কর আদায়ে ঘাটতি ৩০ হাজার ৭৬৮ কোটি টাকা। প্রতি মাসেই আদায়ের লক্ষ্য থেকে পিছিয়ে ছিল এনবিআর। উন্নয়ন প্রকল্পের খরচ কমেছে। আওয়ামী লীগ–ঘনিষ্ঠ অনেক ঠিকাদার পালিয়ে থাকার কারণে এডিপি বাস্তবায়ন পরিস্থিতি খুবই খারাপ। আগের বছরের তুলনায় জুলাই-নভেম্বর সময়ে সাড়ে ১২ হাজার কোটি টাকা কম খরচ হয়েছে।
দিশেহারা ব্যাংকিং খাত
আওয়ামী লীগের শাসনামলে দিনদুপুরে ব্যাংক দখল করা ছিল প্রকাশ্য বিষয়। এতে রাষ্ট্রের বিভিন্ন সংস্থা থেকে শুরু করে খোদ কেন্দ্রীয় ব্যাংকেরও সমর্থন ছিল। তার ওপর ইসলামী ধারার কয়েকটি ব্যাংককে কেন্দ্রীয় ব্যাংক টাকা ছাপিয়ে দেওয়ার পর তা ঋণের নামে লোপাট করা হয়। ঋণ জালিয়াতির টাকাগুলো পাচার করা হয় বিদেশে। তাতে আমানতকারীদের জমানো অর্থের নিরাপত্তা কমে যায়। এ ছাড়া ব্যাংকঋণের সুদের হার ৯ শতাংশে ও ডলারের দাম আটকে রেখে একশ্রেণীর ব্যবসায়ীকে সুবিধা দেওয়া হয়। সব মিলিয়ে বেসামাল হয়ে পড়ে দেশের অর্থনীতি।
৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের পর ব্যাংক খাতে বড় ধরনের সংস্কারের উদ্যোগ শুরু হয়। এতে ১১টি ব্যাংকের পরিচালনা পষর্দ ভেঙে সেগুলোর আসল চিত্র বের করে আনা, খেলাপি ঋণের প্রকৃত অবস্থা উদ্ঘাটন ও মার্কিন ডলারের সংকট মেটানো—এগুলো প্রাধান্য পায়। এরই মধ্যে ডলারের সংকট মিটিয়ে রিজার্ভের পতন থামানো গেছে। ব্যাংক খাতে অবাধ লুটপাট বন্ধ হয়েছে। তবে অন্যান্য উদ্যোগের সুফল পাওয়া নিয়ে সন্দেহ তৈরি হয়েছে। সংস্কারপ্রক্রিয়া এগিয়ে নিতে সরকার ও গভর্নরের যে তাড়না রয়েছে, ততটা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের মধ্যে লক্ষ করা যাচ্ছে না। ফলে সংস্কারপ্রক্রিয়ার গতি ইতিমধ্যে ধীর হয়ে পড়েছে।
দেশের বিশিষ্টজনদের মতে, ১৫ বছরে যে জঞ্জাল তৈরি হয়েছে তা পাঁচ মাসে সারবে না। সুদ ও ডলারের দাম নির্দিষ্ট করে রাখার পাশাপাশি নানা অনিয়ম হয়েছিল। তা জেনেও সবাই চুপ ছিল। প্রকাশ্যে এসবের সমালোচনা করা যেত না, এখন তা করা যাচ্ছে। সংস্কারের বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তবে বলার মতো কোনো সমাধান হয়নি। এখনো অনেকে সংস্কারের বিপক্ষে রয়ে গেছেন। এ জন্য এই খাতের সবাইকে যুক্ত করে সংস্কারপ্রক্রিয়া এগিয়ে নিলে সমাধান মিলবে। তাহলে সামনে নতুন সরকার গঠন হলেও সংস্কারপ্রক্রিয়া এগিয়ে নেওয়া যাবে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে অর্থনীতির যেসব খাত সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হয়েছে সেগুলোর মধ্যে ব্যাংক অন্যতম। এ জন্য ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর সংস্কারের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পায় এই খাত। নতুন সরকার গঠনের পর ১১টি ব্যাংক ও একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পষর্দ ভেঙে দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর মধ্যে ১০টির মালিকানার সঙ্গে যুক্ত ছিল বহুল আলোচিত এস আলম গ্রæপ।
পাশাপাশি মোবাইলে আর্থিক সেবাদাতা (এমএফএস) প্রতিষ্ঠান নগদের পরিচালনা পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনা কার্যক্রমের নিয়ন্ত্রণ হাতে নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।


ব্যাংক খাত সংস্কারে একটি টাস্কফোর্স গঠন করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। অনিয়মের শিকার ব্যাংকগুলোর সম্পদের প্রকৃত মান বের করবে এই টাস্কফোর্স। এসব ব্যাংকে ফরেনসিক নিরীক্ষা করবে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান, যা শুরু হচ্ছে আগামী মাসেই। এ জন্য একটি পৃথক বিধিও তৈরি করা হয়েছে। দুর্বল ব্যাংকগুলোর সম্পদের মান বের করার পর এই বিধির অধীনে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
ব্যাংক খাতকে কৃষ্ণগহবরের (ব্ল্যাকহোল) সঙ্গে তুলনা করেছে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতিবিষয়ক শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি। কমিটির চূড়ান্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের ব্যাংক খাতে দুর্দশাগ্রস্ত ঋণের পরিমাণ এখন ৬ লাখ ৭৫ হাজার কোটি টাকা, যে অর্থ দিয়ে ১৩টি মেট্রোরেল বা ২২টি পদ্মা সেতু নির্মাণ করা যেত। গত দেড় দশকে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি হয়েছে ব্যাংক খাতে, ফলে খাতটি বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। ব্যাংক খাতের দুর্নীতিবাজেরা সবাই ছিলেন প্রভাবশালী।
শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রতিবেদন জমা অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেন, ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ আগামী দিনে মোট ঋণের ২৫ থেকে ৩০ শতাংশে পৌঁছে যাবে। এসব ঋণের বড় অংশই ২০১৭ সালের পর দেওয়া হয়েছে, যার একটি বড় অংশই পাচার হয়ে গেছে। এদিক ব্রিটিশ গণমাধ্যম ফাইন্যান্সিয়াল টাইমসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে আহসান এইচ মনসুর বলেন, সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার (ডিজিএফআই) সহায়তায় কয়েকটি ব্যাংক দখল করার পর এস আলম গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাইফুল আলম ও তাঁর সহযোগীরা ব্যাংকব্যবস্থা থেকে ‘অন্তত’ ১০ বিলিয়ন বা ১ হাজার কোটি মার্কিন ডলার ‘বের করে’ নিয়েছেন। তাঁরা প্রতিদিনই নিজেদের নামে ঋণ অনুমোদন করেছেন। এসব ব্যাংক দখল করে আনুমানিক ২ লাখ কোটি টাকা (১ হাজার ৬৭০ কোটি ডলার) দেশ থেকে পাচার করা হয়েছে। জানা গেছে, এস আলম গ্রæপ একাই ইসলামী ব্যাংকের দেওয়া মোট ঋণের প্রায় অর্ধেক বা ৭৩ হাজার কোটি টাকা, ইউনিয়ন ব্যাংকের ঋণের ৬৪ শতাংশ বা ১৮ হাজার কোটি টাকা, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের ৬০ শতাংশ বা ৩৫ হাজার কোটি টাকা ও গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের ৯০ শতাংশ নিয়ে গেছে। একইভাবে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, জনতা ব্যাংক, রূপালী ব্যাংক এবং ইউসিবিতেও গ্রæপটির ঋণ রয়েছে। এদিকে সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী (জাভেদ) ইউসিবি থেকে, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান আইএফআইসি ব্যাংক থেকে, সিকদার পরিবার ন্যাশনাল ব্যাংক থেকে বড় অঙ্কের অর্থ তুলে নিয়েছে। এসব ঋণ খেলাপি হয়ে পড়ছে। এর ফলে বাড়ছে খেলাপি ঋণ। দেশের ব্যাংকগুলোতে গত সেপ্টেম্বর শেষে খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৮৪ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা। তিন মাসেই ব্যাংকব্যবস্থায় খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৭৩ হাজার ৫৮৬ কোটি টাকা। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতা হারানো আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ব্যাংক থেকে নামে-বেনামে যে অর্থ বের করে নেওয়া হয়েছে, তা এখন খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত হতে শুরু করেছে। ফলে ব্যাংক থেকে বিতরণ করা ঋণের প্রায় ১৭ শতাংশই বর্তমানে খেলাপিতে পরিণত হয়েছে। ব্যাংক খাত যে পর্যায়ে চলে এসেছে তাতে সংস্কার না হলে অর্থনীতি এগিয়ে নেওয়া কঠিন হয়ে পড়বে। এই বাস্তবতা সবাইকে বুঝতে হবে। বর্তমান সরকার এটা বুঝতে পেরে উদ্যোগ নিয়েছে। সামনে যারা ক্ষমতায় আসবেন, তাদেরও এই বাস্তবতা বুঝতে হবে। তা ছাড়া এখনই আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে হবে, বিনিয়োগকারীদের সুরক্ষা দিতে হবে বলে মনে করেন দেশের অভিজ্ঞমহল।
প্রবাসী আয়ে অর্থনীতির গতি কিছুটা ফিরছে
অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে রপ্তানি ও প্রবাসে আয়ে কিছুটা গতি এসেছে। চার মাস ধরে প্রতি মাসেই ২০০ কোটি ডলারের বেশি প্রবাসী আয় এসেছে। আর চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে প্রবাসী আয়ে প্রায় ২৬ দশমিক ৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। অন্যদিকে নানামুখী পদক্ষেপের কারণে গত পাঁচ মাসে রপ্তানি আয় দুই হাজার কোটি ডলার ছাড়িয়ে গেছে। রপ্তানি ও প্রবাসী আয় ভালো হওয়ায় তা রিজার্ভের ক্ষয় ঠেকিয়েছে। তবে খেলাপি ঋণ ব্যাপকভাবে বেড়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ব্যাংক থেকে অনিয়ম-দুর্নীতি করে নামে-বেনামে যেসব ঋণ নেওয়া নেওয়া হয়েছে, তা এখন খেলাপি হতে শুরু করেছে। সেপ্টেম্বর শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ২ লাখ ৮৪ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা।
নজরদারিতে দেশের ১০টি শিল্প গ্রুপ
বিভিন্ন ব্যাংক থেকে অর্থ আত্মসাৎ, রাজনৈতিক প্রভাব খাটানো এবং ঘুষকাণ্ড ও দুর্নীতিসহ অবৈধ পন্থায় অর্থ উপার্জনের কারণে দেশের শীর্ষস্থানীয় ১০টি শিল্পগোষ্ঠীর অবৈধ অর্থ অর্জন, কর ফাঁকি ও অর্থ পাচার খতিয়ে দেখতে যৌথ তদন্ত শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) এবং কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর। এর মধ্যে ৬টি গ্রæপের তদন্তে দুদক ও ৪টির তদন্তে সিআইডি নেতৃত্ব দিচ্ছে। তদন্ত শেষে এসব প্রতিবেদন আদালতে দাখিল করবে সংস্থা দুটি। দুদক ও সিআইডির যৌথ এ তদন্ত সমন্বয় করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা শাখা বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। আর আইনি সহায়তা দিচ্ছে অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয়। যে ১০ শিল্পগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু হয়েছে সেগুলো হচ্ছে- এস আলম, বেক্সিমকো, নাবিল, সামিট, ওরিয়ন, জেমকন, নাসা, বসুন্ধরা, সিকদার ও সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর আরামিট গ্রুপ। এর মধ্যে সিআইডি তদন্ত করছে এস আলম, বেক্সিমকো, নাবিল ও জেমকন গ্রুপের আর্থিক অনিয়ম ও অর্থ পাচারের বিষয়ে। বাকি ৬টির তদন্তে নেতৃত্ব দিচ্ছে দুদক।


দুদক, সিআইডি ও কাস্টমস গোয়েন্দাকে দেওয়া বিএফআইইউর চিঠিতে বলা হয়েছে, এসব গ্রæপ ও তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি/প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতি, প্রতারণা ও জালিয়াতির মাধ্যমে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে অর্থ আত্মসাৎ, রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে ঘুষ, দুর্নীতিসহ অবৈধ পন্থায় অর্থ উপার্জনের তথ্য পাওয়া গেছে। এ ছাড়া এসব ব্যবসায়িক গ্রুপের বিরুদ্ধে কর ও শুল্ক ফাঁকি এবং বৈদেশিক বাণিজ্যের আড়ালে অর্থ পাচারসহ বিভিন্ন অবৈধ পন্থায় বিদেশে অর্থ পাচারের তথ্য রয়েছে। চিঠিতে আরও বলা হয়, অনুসন্ধান ও তদন্ত কার্যক্রমের হালনাগাদ প্রতিবেদন সময়-সময় সংস্থাগুলোকে ‘বিদেশে পাচারকৃত সম্পদ বাংলাদেশে ফেরত আনা ও ব্যবস্থাপনার লক্ষ্যে আন্তসংস্থা টাস্কফোর্স’ ও বিএফআইইউতে সরবরাহ করতে হবে।
নিত্য প্রয়েজনীয় ভোগ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধিতে অতিষ্ট জনজীবন
বিদায়ী ২০২৪ সালে নিত্যপণ্যসহ বিভিন্ন জিনিসপত্রের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধিতে মানুষের দৈনন্দিন জীবন অতিষ্ট। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার যেমন দাম কমাতে পারেনি, তেমনি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারও তাদের চার মাসের চেষ্টায় তেমন একটা সফল হয়নি। ফলে বছরজুড়ে গরিব ও সীমিত আয়ের মানুষ বাজারে গিয়ে দামের চাপে পিষ্ট হয়েছেন। মধ্যবিত্তের জীবনও কঠিন ও রূঢ় হয়ে গেছে। তাদের পাত থেকে খাবারের কিছু পদ কমেছে। নিত্যপণ্যের দাম পরিস্থিতি বিবেচনা করে সুপারশপগুলো মধ্যবিত্ত গ্রাহক ধরে রাখতে ব্যবসায়িক কৌশল পাল্টেছে। মিনি প্যাক শ্যাম্পুর মতো গরুর মাংস, মাছ, মুরগি, সবজিসহ বিভিন্ন পণ্যের কম্বো প্যাকেজ নিয়ে এসেছে, যা দেশের উচ্চ মূল্যস্ফীতিতে সাধারণ ক্রেতাদের অসহায় আত্মসমর্পণের বার্তা দেয়।সরকার পরিবর্তন, তীব্র তাপপ্রবাহ, একাধিক বন্যা, পণ্য সরবরাহে ঘাটতি, আমদানি ও জ্বালানি ব্যয় বৃদ্ধি প্রভৃতি কারণে বছরজুড়ে দেশে নিত্যপণ্যের বাজার অনেকটাই অস্থিতিশীল ছিল। বিশেষ করে ফার্মের মুরগি ও ডিম, আলু, পেঁয়াজ, চাল, সয়াবিন তেল এবং বিভিন্ন সবজির বাড়তি দামে ভোগান্তিতে ছিলেন নিম্ন ও সীমিত আয়ের মানুষেরা। নিত্যপণ্যের দাম ও সরবরাহ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে একপর্যায়ে সরকার বেশ কিছু পণ্য আমদানিতে শুল্ক কমায়। সরকারের এসব উদ্যোগে বছরের শেষ দিকে এসে কিছু পণ্যের দাম অবশ্য কমেছে। পাশাপাশি তিনটি সংস্থার মাধ্যমে খোলাবাজারে সাশ্রয়ী মূল্যে চাল, আটা, তেল, ডিম ও বিভিন্ন সবজি বিক্রির কার্যক্রম শুরু করে সরকার। তবে চাহিদার তুলনায় এসব পণ্যের পরিমাণ ছিল অনেক কম। জিনিসপত্রের চড়া দামের কারণে পুরো বছরে মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ শতাংশের ওপরে। একপর্যায়ে তা দুই অঙ্কের ঘর ছাড়িয়ে যায়। বিশেষ করে দেশে গত ১১ মাসের মধ্যে আট মাসেই খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ১০ শতাংশের ওপরে। এর মধ্যে গত জুলাই মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেড়ে ১৪ দশমিক ১০ শতাংশে ওঠে, যা গত ১৩ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।
বছরজুড়ে কয়েক দফা বন্যা ও প্রচণ্ড তাপপ্রবাহের কারণে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে কয়েক লাখ মুরগি মারা যায়। এতে একদিকে আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ে অনেক খামার বন্ধ হয়ে যায়, অন্যদিকে বাজারে ফার্মের মুরগি ও ডিম সরবরাহে বড় ঘাটতি তৈরি হয়। এর প্রভাব পড়ে ডিম-মুরগির দামে। বাজার পর্যালোচনায় দেখা গেছে, এই বছরের পুরো সময়েই প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগির দাম ১৮০-২১০ টাকার মধ্যে ওঠানামা করেছে। গতকাল বৃহস্পতিবারও বাজারে ২১০ টাকা কেজি ব্রয়লার মুরগি বিক্রি হয়েছে। ডিমের দামও বেশ কয়েক মাস ধরে চড়া ছিল। গত সেপ্টেম্বর মাসের দিকে এক ডজন ডিমের দাম ১৯০ টাকায় ওঠে। বছরের শেষ দিকে এসে বাজারে বোতলজাত সয়াবিন তেলের সংকট তৈরি হয়। ভোজ্যতেল কোম্পানিগুলোর দাবির প্রেক্ষাপটে সয়াবিন তেলের দাম লিটারে আট টাকা বাড়ানো হয়। তবে দাম বাড়ানোর পরও সয়াবিন তেলের সরবরাহ এখনো স্বাভাবিক হয়নি।
চালের দামও বেড়েছে কয়েক দফায়। সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য অনুসারে, এক বছর আগের তুলনায় খুচরা পর্যায়ে সরু ও মাঝারি চালের দাম ১৩-১৪ শতাংশ এবং মোটা চালের দাম ৭ শতাংশ বেড়েছে।
চলতি বছর লম্বা সময় ধরে উচ্চ মূল্যে স্থির ছিল আলু ও পেঁয়াজের দাম। পণ্য দুটির উৎপাদন ও মজুত পর্যাপ্ত থাকলেও মধ্যস্বত্বভোগীদের কারণে দাম কমেনি। টিসিবির পর্যালোচনায় দেখা যায়, এবার মৌসুমের শুরুতে প্রতি কেজি আলু ৪০-৫০ টাকায় বিক্রি হয়েছে, যা পরে ৫৫-৬০ টাকায় ওঠে। তবে অক্টোবর মাসে দাম বেড়ে ৮০ টাকায় পৌঁছায় আলুর কেজি। এখন কিছুটা কমে এসেছে। আগের বছরগুলোয় মৌসুমে প্রতি কেজি আলু ১৮-২০ টাকায় ও এরপর ২২-৩০ টাকায় বিক্রি হতো। অন্যদিকে পেঁয়াজের মৌসুম এবার শুরুই হয়েছিল উচ্চ দামে। গত ফেব্রæয়ারিতে নতুন পেঁয়াজ ৮০-১০০ টাকা কেজি বিক্রি হয়েছে। এপ্রিলে দাম কিছুটা কমে আবার বেড়ে যায়। নভেম্বরে প্রতি কেজি পেঁয়াজের দাম ১৫০ টাকা ছাড়িয়ে যায়। দাম বেড়ে যাওয়ায় ভোক্তাদের অস্বস্তি হলেও কৃষকদের মুখের হাসি চড়া হয়। অতীতে মৌসুমের শুরুতে দেশি পেঁয়াজের কেজি ৪০ টাকার নিচে থাকতো। সারা বছর সবজির দামও মানুষকে ঋণগিয়েছে। গত সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে সবজির দাম অনেকটা সাধারণ ক্রেতাদের নাগালের বাইরে চলে যায়। তখন প্রতি কেজি কাঁচা মরিচ ৩০০-৩৫০ টাকা, বেগুন ১২০-১৮০ টাকা; ঢ্যাঁড়স, পটোল, ধুন্দুল ও চিচিঙ্গা ৮০-১০০ টাকা; কাঁকরোল, করলা ও বরবটি ১২০-১৪০ টাকায় বিক্রি হয়। সবজির এমন উচ্চ দামে চরম ভোগান্তিতে পড়েন নিম্ন ও সীমিত আয়ের মানুষ।অর্ন্তবর্তী সরকারের নানা উদ্যোগে নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণ ও সরবরাহ পরিস্থিতি ঠিক করতে সরকার বেশ কিছু পদক্ষেপ নেয়। এর মধ্যে বেশির ভাগ পদক্ষেপ নেয় অন্তর্বর্তী সরকার, গত সেপ্টেম্বর-নভেম্বর মাসে। যেমন গত অক্টোবরে চাল আমদানিতে বিদ্যমান তিন ধরনের শুল্ক কমানো হয়। এর মধ্যে আমদানি শুল্ক কমিয়ে ১৫ শতাংশ, নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক কমিয়ে ৫ শতাংশ ও বিদ্যমান আগাম কর পুরোপুরি প্রত্যাহার করা হয়।
এভাবে সেপ্টেম্বরে আলু আমদানিতে ২৫ শতাংশ শুল্ক কমিয়ে ১৫ শতাংশ ও বিদ্যমান ৩ শতাংশ নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করা হয়। অক্টোবরে ডিম আমদানিতে শুল্কহার ২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ করা হয়। পাশাপাশি অপরিশোধিত ও পরিশোধিত চিনির ওপর বিদ্যমান নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক কমিয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে। ভোজ্যতেল আমদানিতেও বিদ্যমান মূল্য সংযোজন কর (মূসক) কমিয়ে ৫ শতাংশ করা হয়। আর নভেম্বরে পেঁয়াজ আমদানিতে শুল্ক-কর সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করা হয়। এর পাশাপাশি টিসিবিসহ কয়েকটি সংস্থার মাধ্যমে খোলাবাজারে সাশ্রয়ী মূল্যে বিভিন্ন পণ্য বিক্রি শুরু করে সরকার। যেমন গত অক্টোবরের শেষ দিকে এসে সাধারণ ভোক্তাদের কাছে ট্রাকে (ঢাকা ও চট্টগ্রামে) করে ভর্তুকি মূল্যে তেল, ডাল ও চাল বিক্রির উদ্যোগ নেয় টিসিবি। অন্যদিকে সবজির দাম বাড়লে গত অক্টোবরে কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের মাধ্যমে ট্রাকে করে সাশ্রয়ী দামে আলু, ডিম, পেঁয়াজসহ বিভিন্ন সবজি বিক্রি করা হয়। এ ছাড়া খাদ্য অধিদপ্তরের ওএমএস কার্যক্রমের মাধ্যমে চাল-আটা বিক্রির কার্যক্রমও চলে।
বিশেষজ্ঞদের দৃষ্টিতে অর্থনীতি
বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ২০২৪ সালের অর্থনীতিকে দুই ভাগে দেখতে হবে। একটি আগের সরকারের আমলের, অপরটি ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পরের অংশ। আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে আর্থসামাজিক খাতে অগ্রগতি সত্তে¡ও অর্থনীতির ঋেণরে বিভিন্ন ধরনের চাপ সৃষ্টি হচ্ছিল। যেমন বণ্টনের অন্যায্যতা, ক্রয়ক্ষমতার অবনমন, বিনিময় হারে বড় ধস, উচ্চ মূল্যস্ফীতি। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের পেছনেও অর্থনীতির পুঞ্জীভূত সমস্যা ভূমিকা রেখেছে।
মোস্তাফিজুর বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে অর্থনীতি ও সুশাসন নিয়ে বড় প্রত্যাশা রয়েছে। পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা নিয়ে দ্বিতীয় অধ্যায় শুরু হয়েছে। বৈষম্য ও বণ্টনের ন্যায্যতা-এসব বিষয় আলোচনায় এসেছে। কিন্তু এখনো অর্থনীতির বিভিন্ন সমস্যা বিরাজমান। যেমন উচ্চ মূল্যস্ফীতি, সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার অবনমনের অব্যাহত ধারা। অন্তর্বর্তী সরকার সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি, রাজস্ব নীতি, বাজার তদারকির মাধ্যমে মূল্যস্ফীতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু অর্থনীতির অনেক সূচকে পরিবর্তন আনতে পারেনি, অর্থনীতি গতি পায়নি। বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতির গতি-প্রকৃতি দীর্ঘদিন ধরে পর্যালোচনা করেন অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন। তিনি বিশ্বব্যাংকের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট। অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত অর্থনীতির ওপর শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির অন্যতম সদস্য ছিলেন। তিনি মনে করেন, গণঅভ্যুত্থানের ফলে সরকার পরিবর্তনের কারণে ২০২৪ সাল একটি বিশেষ বছর। একটি ভিন্ন পরিস্থিতি। অর্থনীতি নিয়ে আলোচনায় বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে। তিনি আরও বলেন, বিদায়ী অর্থনীতি ভালো যায়নি। বড় সূচকগুলো দুর্বল। উচ্চ মূল্যস্ফীতি গেড়ে বসে আছে। ওপরের দিকে উঠছে, নামার লক্ষণ নেই। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি দুর্বল। অনেক ধরনের অনিশ্চয়তার কারণে বিনিয়োগ থমকে আছে। সারা বছর ধরেই অর্থনীতি দুর্দশার মধ্যে ছিল। বদায়ী বছরে আর্থিক খাতের পরিস্থিতি নিয়ে জাহিদ হোসেন বলেন, আর্থিক খাতের দুর্দশা চলমান। ব্যাংকের দুর্দশাগ্রস্ত সম্পদ বেড়েছে। তারল্য সংকট রয়েছে। সরকার পরিবর্তনের পর আর্থিক খাতে নেতৃত্বের পরিবর্তন হয়েছে। নতুন নেতৃত্ব রক্তক্ষরণ বন্ধের উদ্যোগ নিয়েছে। তবে ফলাফল পেতে সময় লাগবে। জ্বালানি খাতে গ্যাসের সংকট ছিল বছরজুড়ে। এ খাতের প্রতিষ্ঠানগুলো আর্থিকভাবে বিপর্যস্ত। টাকা ও ডলার দুটিই তারা ঠিকমতো পরিশোধ করতে পারছে না।
অর্থনীতির দুর্দশা কাটানোর উপায় কী- জানতে চাইলে জাহিদ হোসেন বলেন, দুটি বিষয় খুবই জরুরি। প্রথমত, খাদ্যপণ্যের উচ্চ মূল্যস্ফীতি কমাতে প্রধান প্রধান নিত্যপণ্যের বাজার ব্যবস্থাপনায় বিশেষ নজর দিতে হবে। বাজারে খুচরা বিক্রেতাদের ওপর পুলিশি কায়দায় ব্যবস্থা নিয়ে লাভ হবে না। চাহিদা, সরবরাহ, লেনদেন, প্রতিযোগিতা– এসবের সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে বাজার মনিটর করতে হবে। সরবরাহ চেইনে কোথায় মূল্য কৃত্রিমভাবে বাড়ানো হচ্ছে, চিহ্নিত করতে হবে এবং তার প্রতিকার করতে হবে। দ্বিতীয়ত, দৈনন্দিন জীবনে মানুষ যাতে নির্বিঘেœ চলাচল করতে পারে, তার ব্যবস্থা করতে হবে। মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। মূল্যস্ফীতি কমাতে না পারলে এবং মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে না পারলে অর্থনীতি সচল করা কঠিন হবে। তিনি আরও বলেন, বুঝতে হবে, গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে যে পরিবর্তন হয়েছে, তা তো ব্যথাবিহীন নয়। অর্থনীতিতে তা বেদনা বাড়িয়েছে। তার পরও বছর শেষে কিছু আশার আলো দেখা যাচ্ছে। সংস্কার নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এর ফলাফল হয়তো আগামীতে পাওয়া যাবে।
শেষের কথা
পরিশেষে বলা যায় যে, মুদ্রানীতিতে সুদের হার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হয়েছে। এতে সাফল্য পাওয়া যায়নি। প্রকৃত অর্থে মুদ্রানীতি, রাজস্ব নীতি ও বাজার তদারকি- এই তিনটির সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে।বলতে গেলে, দেশের অর্থনৈতিক সমস্যা সমাধানের জন্য সর্বাগ্রে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। পাশাপাশি দেশের রাজনীতিকে স্থিতিশীল রাখতে হবে। এর বাস্তবায়নে প্রয়োজনে জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। স্থিতিশীল হোক দেশের রাজনীতি ও গতিশীল হোক দেশের অর্থনীতি। বিদায় ২০২৪ নবযাত্রায় শুভ হোক ২০২৫; এটিই আমাদের একমাত্র প্রত্যাশা।

সর্বশেষ - আইন-আদালত